বেন স্টোকস। ছবি: বিসিসিআই।
টানা ব্যর্থতার পর ব্রেন্ডন ম্যাকালামকে টেস্ট দলের কোচ করেছিল ইংল্যান্ড। অধিনায়ক করা হয়েছিল বেন স্টোকসকে। তার পর থেকে ‘বাজ়বল’ দর্শনে টেস্ট খেলছে ইংল্যান্ড। ফলও হাতেনাতে পেয়েছিল ইংরেজরা। জো রুটের জমানার ব্যর্থতা মুছে একের পর এক সিরিজ় জিতেছে তারা। শেষে ধাক্কা খেতে হল ভারতের মাটিতে। ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পরেও ১-৪ ব্যবধানে সিরিজ় হারলেন স্টোকসেরা।
ডব্লিউ জি গ্রেস, জ্যাক হোবস, লেট হটন, ওয়ালি হ্যামন্ড, জিওফ্রে বয়কট বা গ্রাহাম গুচদের ক্রিকেট অতীত। ক্রিকেটের জনক ইংরেজরা এখন লাল বলের লড়াইয়ে বিদেশি পরিকল্পনার ‘দাসত্ব’ করছেন। দুই কিউয়ির ‘বাজ়বল’ (ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালাম আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলাচ্ছেন দলকে। যে হেতু তাঁর ডাকনাম ‘বাজ়’, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটকে বাজ়বল বলা হচ্ছে।) দর্শনই রক্ষণশীল ইংরেজদের নতুন অভ্যাস। জেমস অ্যান্ডারসন, রুটেরা চলছেন ‘জো হুজুর’ করে!
ম্যাকালাম নিউ জ়িল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক। স্টোকসও আদতে নিউ জ়িল্যান্ডের। তাঁর বাবা-মা সেখানেই থাকেন। স্টোকস চেয়েছিলেন নিউ জ়িল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে। নিয়মের জটিলতায় সময় নষ্ট করতে চাননি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতীয় দলকে শক্তিশালী করতে স্টোকসকে লুফে নেয় ইংল্যান্ড। বাজ়বল ক্রিকেট দর্শন ম্যাকালামের মস্তিষ্কজাত। যাতে সম্পূর্ণ সায় ছিল স্টোকসের।
টেস্টের ২২ গজে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন তাঁরা। লাল বলের লড়াইয়ে ঘুমপাড়ানি একঘেয়ে ক্রিকেটের পরিবর্তে উন্মাদনা আনতে চেয়েছিলেন ম্যাকালাম। ফুটবলের তত্ত্ব ‘আক্রমণই সেরা রক্ষণ’কে হাতিয়ার করে প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চেপে ম্যাচ জেতার পরিকল্পনা করেছিলেন। পাঁচ দিনের খেলায় প্রতিপক্ষ গুছিয়ে নেওয়ার আগেই তাদের কোণঠাসা করে দেওয়াই ছিল ম্যাকালামের পরিকল্পনা। তাঁর পরিকল্পনায় সওয়ার ইংরেজদের ক্রিকেট এগোচ্ছিল স্বচ্ছন্দে। ঘরের মাঠে অ্যাশেজ় সিরিজ়ে কিছুটা হোঁচট খেতে হলেও হারেনি ইংল্যান্ড। তার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়, পাকিস্তানের মাটিতেও বাজ়বল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। যা কিউয়ি কোচ-অধিনায়কের তত্ত্বের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করেছে ক্রমাগত। বাড়িয়েছে ইংরেজদের আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসের হুঙ্কার ভারতের মাটিতেও দিয়েছিলেন অ্যান্ডারসনেরা। হায়দরাবাদে প্রথম টেস্ট জেতার পর বাজ়বল দর্শনকে আরও আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁরা। বিশাখাপত্তনমে দ্বিতীয় টেস্টে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পরে অ্যান্ডারসন বলেছিলেন, চতুর্থ ইনিংসে ৬০০ রান তাড়া করেও জিততে পারেন। আগ্রাসী ক্রিকেটের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থাই প্রমাণ হয়েছিল তাঁর বক্তব্যে।
বলা হয়, ভারতের মাটিতে ভারতকে টেস্ট সিরিজ়ে হারানো ক্রিকেট বিশ্বের কঠিনতম কাজগুলির অন্যতম। এই তথ্য অজানা ছিল না ইংল্যান্ডের। ২০১২ সালের পর থেকে দেশের মাটিতে কোনও টেস্ট সিরিজ় হারেনি ভারত। এক যুগ আগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই শেষ বার ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ় হেরেছিল ভারত।
ভারতে আসার আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে শিবির করেছিলেন স্টোকসেরা। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়ার সঙ্গে। এশিয়ার মাটির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। প্রথম টেস্ট জয়ের পর নিজেদের প্রস্তুতির উপর ভরসা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল ইংল্যান্ডের। বাজ়বল দর্শন থেকে না সরার কথা বলেছিলেন স্টোকসেরা।
জয় বা পরাজয়ের থেকেও টেস্ট ক্রিকেটের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতেই বেশি আগ্রহী দেখাচ্ছে ইংল্যান্ডকে। বলা ভাল, ম্যাকালামকে। লাল বলের ক্রিকেট নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে চাইছেন। আকর্ষণীয় করতে চাইছেন ক্রিকেটের আদি সংস্করণকে। তাঁর সেই চেষ্টায় হয়তো খামতি নেই। অন্যায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
কোচের কাজ কি শুধুই গবেষণা? পরিকল্পনা বা কৌশল তৈরি করা হয় জয়ের লক্ষ্যে। দলকে সাফল্য এনে দেওয়াই প্রধান কাজ কোচের। ভারতের মাটিতে ভারতকে হারাতে হলে কী ভাবে খেলা দরকার, তা নিয়ে হয়তো ততটা মাথা ঘামাননি আত্মবিশ্বাসী ম্যাকালাম, স্টোকসেরা। প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি নেননি তাঁরা। ইংল্যান্ডের ব্যাটারদের স্পিন বল খেলার দুর্বলতা প্রতি ম্যাচে দেখা গিয়েছে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন, কুলদীপ যাদব, রবীন্দ্র জাডেজাদের বল বুঝতেই পারেননি বেন ডাকেট, অলি পোপ, জনি বেয়ারস্টোরা। অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। রুটের মতো ধ্রুপদী ব্যাটার গিয়ার পরিবর্তন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। ভুল শটে আউট হয়ে দলের বিপদ বৃদ্ধি করেছেন। সেই রুটই আবার রাঁচীর চতুর্থ টেস্ট থেকে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের সিলেবাসে। ফলও পেয়েছেন। ভারতের ২২ গজে কেমন ব্যাটিং দরকার রুট বুঝেছেন ১-২ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার পর। তবু ম্যাকালাম, স্টোকসেরা ‘বাজ়বল’কেই লালন করেছেন। ভারতের মাটিতে নিজেদের প্রয়োগ করতে পারেননি ইংল্যান্ডের বোলারেরাও। জোরে বোলার বা স্পিনার কেউই প্রত্যাশিত সাফল্য দিতে পারেননি ইংল্যান্ডকে। পাক বংশোদ্ভূত একাধিক স্পিনারকে ভারত সফরে নিয়ে এসেছিলেন ম্যাকালাম। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চেয়েছিলেন। কিউয়ি কোচ বোঝেননি, ইংরেজ ব্যাটারদের সামনে যাঁদের কাঁটা মনে হয়, যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমন গিল, সরফরাজ় খান, ধ্রুব জুরেলদের সামনে তাঁরা সাদামাঠা। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় সুনীল গাওস্কর বলেন, ‘‘ভারতীয় ব্যাটারেরা স্কুল ক্রিকেটে যে স্পিনারদের বিরুদ্ধে খেলে, তাদের হাতেও প্রচুর বৈচিত্র। যা অন্য দেশের স্পিনারদের হাতে নেই।’’
ইংল্যান্ডের বাজ়বল ক্রিকেট নিয়ে টানা উচ্ছ্বাস দেখিয়ে এসেছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশও। সাফল্য থাকলে উচ্ছ্বাস থাকবেই। ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ়ের পর সেই উচ্ছ্বাস ধরে রাখা সমস্যা হতে পারে। গাওস্কর, রবি শাস্ত্রীদের ক্রিকেট জ্ঞান আগেই সতর্ক করেছিল ইংরেজদের। এ দেশের মাটিতে বাজ়বল চলবে না, বলে দিয়েছিলেন তাঁরা। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটারদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেননি ম্যাকালামেরা। মাইকেল ভন, কেভিন পিটারসেন, নাসের হুসেনদের সমর্থন পেয়ে স্বস্তিতে ছিলেন। যা সিরিজ় শেষে ১-৪ ব্যবধানে তাঁর কাছে অস্বস্তির হতে পারে।
ধর্মশালায় ম্যাচ শেষ হওয়ার পর স্টোকস সতীর্থদের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করেছেন। অ্যান্ডারসন, রুট, টম হার্টলি, শোয়েব বসির, ডাকেটদের ক্রিকেটীয় দক্ষতার কথা বলেছেন। যেটা বলেননি সেটা হল, ইংরেজ ক্রিকেটারদের দক্ষতা ভারতের মাটিতে রোহিতদের হারানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আগ্রাসী ব্যাটিং ভারতের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে স্টোকসের বক্তব্য, ‘‘সিরিজ়ে ভারত অধিকাংশ সময়ই একপেশে ক্রিকেট খেলেছে। অশ্বিন, কুলদীপ, বুমরা, জাডেজার মতো বোলারদের খেলা সহজ নয়। এই ধরনের বোলারদের বিরুদ্ধে কী ভাবে সাফল্য পাওয়া যেতে পারে, তার উপায় খুঁজতে হবে। সেই মতো ঝুঁকি নিতে হবে। হতে পারে আমরা এই সিরিজ় হেরেছি। তবু ইতিবাচক থাকছি। আগ্রাসী ক্রিকেট একটা পদ্ধতি। আমরা এ ভাবেই এগোতে চাই।’’ বাজ়বল অভ্যাস না বদলানোর কথা বলেছেন স্টোকস। নিজেদের পদ্ধতিতে আস্থা রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু পাঁচ ম্যাচের সিরিজ় শেষ হওয়ার পরেও ভারতীয় বোলারদের সামলানোর উপায় বার করতে না পারা তাঁদের ব্যর্থতাকেই চিহ্নিত করবে।
বাজ়বল নিয়ে পঞ্চম টেস্টের আগে ডাকেটকে খোঁচা দিয়েছিলেন রোহিত। বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ঋষভ পন্থ নামে এক জন ক্রিকেটার ছিল। যার খেলা হয়তো দেখেনি ডাকেট।’’ চিমটিটা বুঝতে বুদ্ধিমানদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এক বছরের বেশি মাঠের বাইরে থাকা পন্থ দেখিয়ে দিয়েছেন, টেস্টে আগ্রাসী ব্যাটিং কাকে বলে। তখনও জন্ম হয়নি বাজ়বলের। টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পার্থক্য হয়তো এ বার বুঝবেন কলকাতা নাইট রাইডার্সের প্রাক্তন কোচ।
আইপিএল থেকে সোজা ইংল্যান্ডের টেস্ট শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন নিউ জ়িল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ভাবনা চালিয়ে দিয়েছিলেন টেস্টেও। প্রাথমিক সাফল্য তাঁকে বাহবা দিয়েছে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকায় অষ্টম স্থানে নেমে যাওয়ার পরেও কি ইংরেজ বিশেষজ্ঞেরা তাঁর পিঠ চাপড়ে দেবেন? রক্ষণশীল ইংরেজরা হয়তো সেটাও অভ্যাস করে ফেলেছেন নিজেদের ক্রিকেটকে বাঁচাতে। যদিও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম সিরিজ়ের মাঝেই বাজ়বল আঁকড়ে থাকার সমালোচনা করতে শুরু করে দিয়েছে।