আয়ুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
আয়ুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার ক্রীড়ামহল এই নামটার সঙ্গে ততটা পরিচিত নয়। অথচ ১৯ বছরের আয়ুশ্রী ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছেন। ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে এশিয়ান কিকবক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ৪৮ কেজি রিং ইভেন্টে পদক জিতেছেন।
আপাতত পড়াশোনা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন নাকতলার বাসিন্দা। আয়ুশ্রীর লক্ষ্য পেশাদার কিকবক্সার হওয়া। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েই থামিয়ে দিয়েছেন পড়াশোনা। ভারতে কিকবক্সিংয়ের জনপ্রিয়তা নেই। আয় করার পথ অত্যন্ত কঠিন জেনেও ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি। আয়ুশ্রীর খেলাধুলার শুরু অবশ্য মার্শাল আর্টে নয়। জলে। একটা সময় পর্যন্ত সাঁতার কাটতেন। ফ্রিস্টাইলের ৫০ এবং ১০০ মিটার এবং ব্যাক স্ট্রোকের ৫০ মিটার ছিল তাঁর মূল ইভেন্ট। পাঁচ বার জুনিয়র ন্যাশনালে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সাঁতারে জাতীয় স্তরে পদকও রয়েছে তাঁর। চেয়েছিলেন সাঁতারু হিসাবেই নিজেকে গড়ে তুলতে। আর্থিক টানাটানি এবং আরও কিছু কারণে প্রিয় সাঁতার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন কোভিডের সময়।
সাঁতার ছাড়লেও খেলা ছেড়ে থাকতে পারেননি। ‘খেলা পাগল’ মেয়ে বেছে নেন মার্শাল আর্ট। দেড় বছর আগে শুরু করেন কিকবক্সিং। তার আগে গ্র্যাপলিং এবং মুয়ে থাই করতেন। ভিত তৈরিই ছিল। কিকবক্সিংয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। দ্রুত সাফল্য আসতেও শুরু করে। জাতীয় স্তরে সাফল্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ এনে দেয়। গত ৬ থেকে ১৩ অক্টোবর কম্বোডিয়ায় আয়োজিত এশিয়ান কিকবক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের ভারতীয় দলে সুযোগ পান আয়ুশ্রী। প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হলেও হতাশ করেননি। ব্রোঞ্জ পেয়েছেন মহিলাদের ৪৮ কেজি রিং ইভেন্টে। এই সাফল্য দেশে আর কোনও মহিলার নেই। ৪৬ জনের ভারতীয় দল অংশগ্রহণ করেছিল প্রতিযোগিতায়। বাংলা থেকে ছিলেন তিন জন। ২৬টি পদক জিতেছেন ভারতীয় কিকবক্সারেরা। অন্য রাজ্যের কিকবক্সারেরা তাঁদের রাজ্য সরকারের তরফে আর্থিক সাহায্য পেলেও বাংলার তিন বক্সারের ভাগ্যে তা জোটেনি। নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়েছে।
আর্থিক প্রতিকূলতার কাছে হার না মেনে আয়ুশ্রী নিজের খেলা চালিয়ে যেতে চান। নিজের খেলার খরচ চালাতে ছোটদের খেলা শেখাতে শুরু করেছেন। ফিজ়িক্যাল ট্রেনার হিসাবে কাজ করেন। নিজের কোচের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি একটি ছোট জিমও খুলেছেন। যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ঠিক ততটাই কঠিন আয়ুশ্রীর জীবন। বাবা এক সময় গ্রাফিক ডিজ়াইনের কাজ করলেও এখন কর্মহীন। মা একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। বাবা-মায়ের ভালবাসার বিয়েতে একের পর এক সমস্যা তৈরি হয়েছে। আয়ুশ্রীর জন্মের বছরখানেক পরই তাঁদের বিচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আয়ুশ্রীর মা চলে গিয়েছিলেন বাপের বাড়ি। সেই থেকে মামার বাড়িতে দিদার কাছেই মানুষ। যদিও বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। ১৩ বছর পর কোভিডের সময় থেকে তাঁর মা আবার বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করেছেন। তাতে অশান্তি মেটেনি। বরং নিত্য অশান্তিতে জেরবার আয়ুশ্রী দিন কয়েক বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকার পর দিদার কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হন। বাবার সঙ্গে ছোট থেকেই দূরত্ব। গত চার বছরে মায়ের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে আনুষ্ঠানিক। কালেভদ্রে। আর্থিক সহায়তাও পান না তেমন। ১৯ বছরের আয়ুশ্রী এখন একা। প্রায় নিঃসঙ্গ।
তা হলে? আয়ুশ্রী থামতে নারাজ। আয়ুশ্রীর রক্তে মিশে রয়েছে খেলা। পদকের নেশা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে এক-দেড় বছরের মধ্যে নাম লেখাতে চান পেশাদার কিকবক্সিংয়ে। নিজেকে উন্নত করার জন্য রাজ্য বা দেশের বাইরে যেতেও আপত্তি নেই। শুধু নিজের খেলাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। সরকারি বা বেসরকারি আর্থিক সাহায্য পেলে তাঁর লড়াই কিছুটা সহজ হবে নিশ্চিত। না পেলেও লড়াই ছেড়ে পালাতে নারাজ আয়ুশ্রী।
শুধু লড়াই। জ্ঞান হওয়া থেকেই লড়াই আয়ুশ্রীর ছায়াসঙ্গী। পারিবারিক জীবনে, ব্যক্তিজীবনে, সুইমিং পুলে বা কিকবক্সিংয়ের রিংয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছাড়তেও এক রকম বাধ্য করা হয়েছে তাঁকে। পড়া এবং খেলার মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খেলোয়াড়দের কোটায় ভর্তি হওয়া বা জাতীয় স্তরে একাধিক সাফল্যেও মন গলেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি বা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনও রকম বাড়তি সুবিধা দিতে রাজি হননি তাঁরা। গৃহীত হয়নি আয়ুশ্রীর আবেদন। অগত্যা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নকে নকআউট করে দিতে দ্বিধায় ভোগেননি কিকবক্সার!
কিকবক্সিংয়ের মতো অপরিচিত একটা খেলাকে আঁকড়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় লাগেনি? কোথায় পেলেন এতটা ঝুঁকি নেওয়ার সাহস? আয়ুশ্রী বললেন, ‘‘না। একটুও না। এখন হয়তো খেলাটা জনপ্রিয় নয়। বিশ্বাস করি ধীরে ধীরে ভারতেও জনপ্রিয় হবে খেলাটা। উত্তরবঙ্গে কিন্তু এখনই বেশ জনপ্রিয় কিকবক্সিং। ওখানকার প্রায় সব বড় স্কুলে গুরুত্ব এবং যত্ন সহকারে খেলাটা শেখানো হয়। তা ছাড়া খেলা ছাড়া থাকতে পারব না। এ ছাড়া কখনও কিছু করার কথা ভাবিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হল না ঠিকই। তবে স্নাতক হতেই হবে আমাকে। চাকরির জন্য নয়। নিজের জন্য।’’
আয়ুশ্রী শুধু নিজের জন্যই ভাবেন এখন। ভাবতে বাধ্য হন। তাঁর জন্য ভাবার তেমন কেউ নেই। না। আছেন এক জন আছেন। আয়ুশ্রীর কোচ ঈশান দাস। তিনিই অভিভাবকের মতো। অনুশীলন, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের খরচ জোগান। যতটা সম্ভব পাশে থাকার চেষ্টা করেন ঈশান। ছাত্রীর সঙ্গে তিনিও আরও ভাল কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। নিজেদের স্বপ্ন জুড়ে নিয়েছেন তাঁরা। খেলার রিংয়ের বাইরেও একসঙ্গে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। আয়ুশ্রী-ঈশান নিজেদের জীবনের পথও এক করে নিতে চান ভবিষ্যতে।
আয়ুশ্রী ঘুরতে ভালবাসেন। কিন্তু খেলার চাপে সময় পান না। বিরিয়ানি খেতে ভালবাসেন খুব। যে কোনও ধরনের ‘ফাস্ট ফুড’ তাঁর ভীষণ প্রিয়। কিন্তু কোচের অনুশাসন মেনে চলেন। বিরিয়ানি খাওয়ায় ছাড় বছরে দু’দিন। তার মধ্যে একটা দুর্গাপুজোর অষ্টমী। ‘ফাস্ট ফুড’ ছুঁয়েও দেখেন না। শরীরে ওজন ৪৮ কেজির মধ্যে রাখার চেষ্টা করেন। খুব বেশি হলে ৫০। তার থেকে বেড়ে গেলে বাড়তি পরিশ্রম করে কমিয়ে ফেলতে হয়। অবসর সময় তাঁর সঙ্গী হয় বই। বিভিন্ন বিখ্যাত, সফল মানুষদের জীবনী পড়েন। নিজেকে অনুপ্রাণিত করেন।
এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের পদকটা সোনার হলে খুশি হতেন বেশি। সেমিফাইনালে হার স্বপ্নপূরণ হতে দেয়নি। এর পর? আয়ুশ্রীর আশা, ২০৩২ সালের অলিম্পিক্সে অন্তর্ভুক্ত হবে কিকবক্সিং। তখন তাঁর বয়স হবে ২৭। জ্ঞান হওয়া থেকে লড়াই যাঁর রক্তে, তাঁর কাছে বয়স সংখ্যা মাত্র। জল ছেড়ে ডাঙায় উঠেছেন। প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে আয়ুশ্রী এগিয়ে যেতে চান।