—প্রতীকী চিত্র।
‘‘কল্পনা করুন, যদি মানবশরীরের একটা মানচিত্র থাকত। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে নয়, শরীরের প্রতিটি কোষকে চেনা, তাদের কে কোথায় আছে, কেমন আছে জেনে নেওয়া। কল্পনা করুন একবার...।’’ বক্তা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কেমব্রিজের স্টেম সেল মেডিসিনের চেয়ার, জীববিজ্ঞানী সারা আমালিয়া টাইকম্যান। মঙ্গলবার ‘সায়েন্স সিটি’ ও ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি যখন এ কথা বলছেন, তখন তাঁর কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছেন পড়ুয়া, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিজ্ঞানীরা। এ বছর ‘রামন চেয়ার’-এ সম্মানিত করা হয়েছে সারা এবং আর এক জীববিজ্ঞানী আভিভ রেঘেভকে। এই দুই বিজ্ঞানী একত্রে তৈরি করেছেন ‘হিউম্যান সেল অ্যাটলাস’ প্রজেক্ট, যার উদ্দেশ্য ক্যানসার, অটো-ইমিউন ডিসঅর্ডার, ভাইরাস সংক্রমণের জেরে সৃষ্ট কোনও জটিল রোগের সমাধান খুঁজতে একেবারে মানবদেহের কোষস্তরে অনুসন্ধান।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ছিলেন ‘ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার’ তথা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী পার্থপ্রতিম মজুমদার। আভিভ অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁদের কোষ-মানচিত্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে বলেন সারা। জানান, কী ভাবে বিশ্বজুড়ে ৩ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী এই প্রকল্পে যুক্ত রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৩৯ জন ভারতীয় বিজ্ঞানীও আছেন। সারা বলেন, যে কোনও জটিল রোগের ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক তৈরিতে সাহায্য করবে এই কোষ মানচিত্র। কিন্তু তার জন্য দরকার কোষের ভিতরে উপস্থিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাকে জানা, প্রতিটি কোষের ধরন বুঝতে শেখা।
২০০১ সালে প্রথম বার মানব জিনোমের খসড়াটি প্রকাশ্যে আসে। মানব জিনোমে ৩০০ কোটি বেস-পেয়ার রয়েছে। প্রতিটি ডিএনএ সিকোয়েন্স পরস্পরের থেকে আলাদা। কিন্তু যদি কোষগুলোকে দেখা হয়, তা হলে প্রায় একই রকম লাগে। হিউম্যান জিনোমে রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার জিন। কোনও কোষে কোন জিনগুলি সক্রিয় রয়েছে, সেই অনুযায়ী তার চরিত্র তৈরি হয়। কোনও পেশি কোষে যে জিন সক্রিয় রয়েছে, তা স্নায়ু কোষ কিংবা হৃদপিণ্ডের কোষের থেকে ভিন্ন। কোষের ধরন বুঝতে হলে তার কোন জিনগুলি সক্রিয়, তা বোঝা দরকার।
এই কঠিন কর্মকাণ্ডে জোয়ার আসে ২০০৯ সালে। সারা জানান, একটি নতুন প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের হাতে আসে, যার সাহায্যে কোনও একটি কোষের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে, তার একটি নিউক্লিয়াসে সক্রিয় জিনগুলির সিকোয়েন্স তৈরি করা সম্ভব হয়। এই ‘সিঙ্গল সেল জিনোমিক্স’-এর সাহায্যে প্রতিটি কোষের ধরন, তার রহস্য সমাধান করা যায়। এই প্রযুক্তিটি সাহায্য করে প্রতিটি কোষকে জানতে, তার ধরন চিনতে এবং প্রতিটি কোষে থাকা ২৫ হাজার জিনকে নির্দিষ্ট সজ্জায় সাজাতে। সারার কথায়, ‘‘এই বিপুল পরিমাণ তথ্য সামলানোও অসাধ্য সাধনের মতো। এতে আমাদের সাহায্য করেছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’’
এর সঙ্গে আরও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। একটি টিস্যু বা কলায় কোনও কোষের অবস্থান কোনখানে, সেটিরও গুরুত্ব রয়েছে। সেটি স্থির করে টিস্যুর কাজ কী রকম হবে। কোষের অবস্থান জানতে তখন বিজ্ঞানীরা ‘সিঙ্গল সেল জিনোমিক্স’-এর সঙ্গে ‘স্পেশাল ট্রান্সক্রিপটোমিকস’-কে যোগ করেন। সারা জানান, মানবদেহে ৩৭ লক্ষ কোটি কোষ রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে জানা-বোঝা অবিশ্বাস্য কাজ। সেই জন্য তৈরি হয়েছে একটি কনসর্টিয়াম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা একত্রে কাজ করছেন। সাহায্য নেওয়া হচ্ছে এআই-এর।
পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেন, ‘‘পিছিয়ে নেই ভারতও। তৈরি করা হয়েছে, ‘এশিয়ান ইমিউন ডাইভারসিটি অ্যাটলাস’। তাতে রয়েছে তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান ও ভারত। মূলত ইমিউন কোষগুলিকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে এখানে। ব্যয়বহুল গবেষণা। তবু আরও বেশি অংশগ্রহণ প্রয়োজন।’’