nasa

মঙ্গলে পা দিল নাসার ল্যান্ডার, ৪ ভারতীয় বংশোদ্ভূতের নাম ঢুকল ইতিহাসে

ভারতীয় সময় রাত আড়াইটে নাগাদ লাল মাটি ছুঁল নাসার ল্যান্ডার আর রোভার।

Advertisement
সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০১:০১
জে বব বলরাম (বাঁ দিক থেকে), অনুভব দত্ত, স্বাতী মোহন ও সৌম্য দত্ত। গ্রাফিক:  নিরুপম পাল।

জে বব বলরাম (বাঁ দিক থেকে), অনুভব দত্ত, স্বাতী মোহন ও সৌম্য দত্ত। গ্রাফিক: নিরুপম পাল।

রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় ছিল গোটা পৃথিবী।

ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল বৃহস্পতিবার। ভারতীয় সময় রাত দেড়টা থেকে দু’টোর মধ্যে। লাল গ্রহে পা ছুঁল নাসার মহাকাশযান। নামল একটি সর্বাধুনিক ল্যান্ডার ও রোভার ‘পারসিভের‌্যান্স’। প্রাণের সন্ধানে যা পরে চষে ফেলবে লাল গ্রহের মাটি।

Advertisement

তার পর সেই ল্যান্ডার থেকে মঙ্গলের আকাশে ওড়ানো হবে হেলিকপ্টার। ‘ইনজেনুইটি’। আকাশ থেকে মঙ্গলের আরও বড় এলাকাজুড়ে নজরদারি চালাতে। এই প্রথম অন্য কোনও গ্রহে হেলিকপ্টার ওড়াতে চলেছে সভ্যতা।

এই ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকায় বৃহস্পতিবারই ইতিহাসে ঢুকে যাবে ৪ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূতের নাম। যাদের মধ্যে দু’জন আবার বাঙালি।

তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা। বেঙ্গালুরুর স্বাতী মোহন। ‘পারসিভের‌্যান্স’-এর গাইডেন্স, নেভিগেশন ও কন্ট্রোলস অপারেশন্স (জিএনঅ্যান্ডসি)-এর প্রধান।

বাকি ৩ জনের মধ্যে অন্যতম বেঙ্গালুরুর জে বব বলরাম। অন্য কোনও গ্রহে এ বার প্রথম যে হেলিকপ্টার ওড়াতে চলেছে বিশ্ব, সেই ইনজেনুইটি-র চিফ ইঞ্জিনিয়র।

রয়েছেন অনুভব দত্ত। এখন মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোডায়নামিক্স ও অ্যারোইলেকট্রিসিটি বিভাগের অধ্যাপক। তিন দশক আগেই লাল গ্রহে হেলিকপ্টার ওড়ানোর স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিলেন যে মুষ্টিমেয় কয়েক জন, তাঁদের অন্যতম মহিষাদলের অনুভব।

আর রয়েছেন বর্ধমানের সৌম্য দত্ত। ১৫টি মানুষ একে অন্যের উপর দাঁড়ালে যত উচ্চতা হয়, তেমনই একটি দৈত্যাকার প্যারাশুট নির্মাণ প্রকল্পের অন্যতম কারিগর তিনি। ওই প্যারাশুটে চেপেই মঙ্গলের বুকে নামবে নাসার ‘মার্স ২০২০ রোভার’ পারসিভের‌্যান্স আর ল্যান্ডার।

বর্ধমানের সৌম্যের সেই প্যারাসুট

বাবার চাকরির সূত্রে ছোটবেলা থেকেই বার বার ঠাঁই বদল হয়েছে বর্ধমানের সৌম্যের। স্কুলজীবনের প্রথম পর্বটা কেটেছে দেহরাদুন ও মুম্বইয়ে। তার পর স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আমেরিকায়। টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সৌম্য মাস্টার্স এবং পিএইচডি করেন জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। নাসার ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টারে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে যোগ দেন ৭ বছর আগে। ২০১৩-য়।

এর আগে লাল গ্রহে এত বড় প্যারাসুট আর কখনও পাঠায়নি নাসা। যে প্যারাশুটে চেপে ৯ বছর আগে লাল গ্রহের বুকে পা ছুঁইয়েছিল কিউরিওসিটি রোভার, এ বারের প্যারাশুটের কাছে সেটা শুধুই নস্যি নয়, প্রযুক্তির নিরিখেও বলা যায় ‘সেকেলে’। এমন প্যারাশুট না থাকলে মঙ্গলের বুকে নিরাপদে নামানো সম্ভব হত না মার্স ২০২০ রোভার ও ল্যান্ডার।

সৌম্যের কথায়, ‘‘এ বার এত বড় আকারের প্যারাশুট বানানোর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কারণ, ল্যান্ডার ও রোভারকে মঙ্গলের মাটিতে নামাতে কোনও অরবিটার প্রদক্ষিণ করবে না লাল গ্রহের কক্ষপথে। যে রকেটে চাপিয়ে এ বার পাঠানো হয়েছে মার্স ২০২০ ল্যান্ডার ও রোভার, তা পৃথিবী থেকে সরাসরি মঙ্গলে কক্ষপথে ঢুকে পড়বে। তার পর দ্রুত নামতে শুরু করবে লাল গ্রহে।’’

আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে সৌম্য এ-ও জানালেন, মঙ্গলে নামার সময় ল্যান্ডার ও রোভারের গতিবেগ থাকবে শব্দের গতিবেগের প্রায় দ্বিগুণ (১.৭৫ গুণ)। এই গতিবেগ কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে নিরাপদে লাল গ্রহে ল্যান্ডার ও রোভারের অবতরণের জন্যই সর্বাধুনিক প্যারাশুটের প্রয়োজন। সাড়ে ২১ মিটার ব্যাসের সেই প্যারাশুট খুলতে সময় নেবে বড়জোর ১ থেকে ২ সেকেন্ড। মঙ্গলে পাঠানো এটাই সবচেয়ে বড় সুপারসোনিক প্যারাশুট। ওই প্যারাশুট খোলার সময়েই র‌্যাডারের ক্যামেরা কোন জায়গায় নিরাপদে অবতরণ করা সম্ভব, তার ছবি তুলতে শুরু করবে।

মহিষাদলের অনুভব যখন পাড়ায় ‘ফড়িং’

অনুভবের জন্ম পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের ঘাঘরা গ্রামে। কোনও বায়ুমণ্ডলই নেই যে গ্রহে, সেই মঙ্গলে যে এমন হেলিকপ্টার ওড়ানো সম্ভব, সাড়ে ৩ দশক আগে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে সেই স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন এই অনুভবই। পরে নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারে এ বারের মঙ্গল অভিযানের হেলিকপ্টারের অ্যারোমেকানিক্স সম্পর্কিত যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন অনুভব।

কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুল থেকে ১৯৯৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় একাদশ স্থানটি পান অনুভব। তার পর তিনি বি টেক করেন খড়্গপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) থেকে। পিএইচডি মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনুভব আমেরিকান হেলিকপ্টার সোসাইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা।

মহিষাদলে তাঁর পাড়ার এক পরিচিত বললেন, ‘‘ও ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিল বলে আমরা ওকে ‘ফড়িং’ বলে ডাকতাম। সাঁতার কাটার নেশা ছিল। তাই যখন তখন কলকাতা থেকে চলে আসত মহিষাদলের বাড়িতে।’’

ছোটবেলায় স্টার ট্রেক দেখেই উদ্বুদ্ধ হন বেঙ্গালুরুর স্বাতী

পারসিভের‌্যান্স-এর গাইডেন্স, নেভিগেশন ও কন্ট্রোলস অপারেশন্স (জিএনঅ্যান্ডসি)-এর প্রধান স্বাতীর জন্ম বেঙ্গালুরুতে। জন্মের এক বছর পরেই মা, বাবার সঙ্গে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন স্বাতী। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। ১৯৮৬-তে। তার পর বেড়ে ওঠা, পড়াশোনার পুরোটাই আমেরিকায়। বড় হয়েছেন উত্তর ভার্জিনিয়া ও ওয়াশিংটন ডিসি-তে। মেকানিক্যাল ও অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স (বিএস) করার পর স্বাতী অ্যারোনটিক্স ও অ্যাস্ট্রোনটিক্সে মাস্টার্স অব সায়েন্স (এমএস) করেন ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে। সেখান থেকেই পিএইচডি।

মঙ্গলে পা সভ্যতার। দেখুন নাসার সরাসরি সম্প্রচার। সৌজন্যে: নাসা।

আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে স্বাতী জানালেন, বাবা চিকিৎসক বলেই ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন শিশু চিকিৎসক হওয়ার। ১৬ বছর বয়সে ‘স্টার ট্রেক’ দেখার পর থেক‌ে সেই স্বপ্নটা বদলে যায়। তখন থেকেই ব্রহ্মাণ্ড তাঁকে ভীষণ ভাবে টানতে শুরু করে।

স্বাতীর কথায়, ‘‘৩ থেকে ৫ বছর অন্তর ভারতে যাই। বেঙ্গালুরুতে আমাদের এখনও বাড়ি আছে। মা, বাবা প্রতি বছরই সেখানে গিয়ে কয়েকটা মাস কাটিয়ে আসেন। আমার মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও শিশু চিকিৎসক স্বামী সন্তোষেরও বাড়িও বেঙ্গালুরুতে।’’

এর আগে শনিতে পাঠানো নাসার মহাকাশযান ‘ক্যাসিনি’ এবং চাঁদে পাঠানো যান ‘গ্রেল’-এর অভিযানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন স্বাতী।

স্বাতী জানালেন, মঙ্গলে যেখানে নামবে পারসিভের‌্যান্স, সেই জায়গাটার নাম ‘জেজোরো ক্রেটার’। কোটি কোটি বছর আগে কোনও সুবিশাল আগ্নেয়গিরির জন্য ওই দৈত্যাকার গর্তটি (ক্রেটার) তৈরি হয়েছিল। এলাকাটা ২৮ মাইল জুড়ে। কিন্তু গোটা এলাকাটি ভর্তি খুব উঁচু উঁচু পাহাড়ে। সমতল সেখানে খুবই কম। ৩০০ কি ৪০০ মিটার অন্তর সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। তাই নামার আগে থেকে খুব নিখুঁত ভাবে জায়গাটাকে চিনতে, বুঝতে না পারলে যে কোনও মুহূর্তে স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে। সুউচ্চ পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে পড়তে পারে নাসার ল্যান্ডার ও রোভার। এমনকি তা পাহাড়ের খাঁজে আটকেও অকেজো হয়ে যেতে পারে চিরতরে।

স্বাতীকে নাসা এ বার যে গুরুদায়িত্বগুলি দিয়েছে, তার অন্যতম নিরাপদে পারসিভের‌্যান্সকে লাল গ্রহের জেজোরো ক্রেটারে নামানো।

বেঙ্গালুরুর কন্যা বললেন, ‘‘আমরা একটি বিশেষ ধরনের ল্যান্ডার ভিশন সিস্টেম (এলভিএস) বানিয়েছি। যখনই মহাকাশযান থেকে প্যারাসুট খুলে গিয়ে মঙ্গলের মাটির দিকে নামতে শুরু করবে ল্যান্ডার ও রোভার, তখনই চালু হয়ে যাবে এলভিএস। এটা আসলে ল্যান্ডারের ‘চোখ’। এত দিন এই কাজটা করা হত মহাকাশযানে থাকা র‌্যাডারের মাধ্যমে। সেটা শুধু বলে দিত, কোন এলাকায় নামা যেতে পারে। কিন্তু এ বার আমরা যে ‘চোখ’ (এলভিএস) বানিয়েছি, তা আগে থেকে জানিয়ে দেবে নামার জন্য যে যে এলাকা বাছা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ কোনটি। এ-ও বলে দেবে, তার ২০০ মিটারের মধ্যে কোনও বড় পাথর বা সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আছে কি না। এই পদ্ধতির ভিতটা যে প্রযুক্তির, তার নাম ‘টেরেন-রিলেটিভ নেভিগেশন (টিআরএন)।’’

বেঙ্গালুরুর বলরামের সেই হেলিকপ্টার

হেলিকপ্টার ইনজেনুইটি-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে বব বলরামের জন্মও বেঙ্গালুরুতে। মাদ্রাজের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)’ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে রেনস্‌লার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি-র পর বলরাম জেপিএল-এ চাকরি করতে ঢোকেন ১৯৮৫ সালে।

ওই সময়ের মধ্যেই মঙ্গলে কয়েকটি ল্যান্ডার ও রোভার পাঠানো হয়ে গিয়েছে নাসার। লাল গ্রহের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে প্রাণের সন্ধানে। ওই সময় বলরামেরই প্রথম মাথায় আসে ল্যান্ডারে চাপিয়ে মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠালেই তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সেটা নয়ের দশকের গোড়ার দিক। বলরামের মনে হয়, রোভার যতটা এলাকা ঘুরে দেখতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বেশি এলাকার উপর অনেক কম সময়ে নজরদারির কাজটা সেরে ফেলতে পারবে হেলিকপ্টার।

বলরামের সেই অভিনব ভাবনা গোড়ার দিকে কিন্তু তেমন আমল পায়নি জেপিএল-এ। পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে বলরাম জানিয়েছেন, তিনি যে এমন একটা কিছু ভেবেছেন, কোনও ভাবে তা পৌঁছে যায় জেপিএল-এর তদানীন্তন অধিকর্তা চার্লস এলাচির কানে। লেবানিজ চার্লস ছিলেন অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু প্রথম দিকে তিনিও বলরামের এই ভাবনার কথাটা সাহস করে জানাতে পারেননি ওয়াশিংটনে নাসার সদর দফতরে। ভাবনাটা কতটা কার্যকর হতে পারে, নিজে তা পরখ করে দেখার তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু তার জন্য তো বহু অর্থ লাগবে। পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণায়। সেই অর্থ জোগাড় করা তো সহজ কথা নয়। তার জন্য নাসার সদর দফতরের অনুমোদন প্রয়োজন। যা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেতে হয়। জেপিএল-এর অধিকর্তা হিসাবে অবশ্য চার্লসের নিজস্ব কিছুটা ক্ষমতা ছিল কোনও গবেষণা বা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য চটজলদি তহবিল-বরাদ্দের। সেই অর্থেই শুরু হল পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা। মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠানোর ভাবনা নিয়ে। ২০১৪ থেকে। নিজে নিশ্চিত হওয়ার পর মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠানোর জন্য শেষমেশ ২০১৮-য় নাসার সদর দফতরের অনুমোদন চাইলেন চার্লস। মিলেও গেল বলরামের ভাবনার অভিনবত্বের জন্য।

মঙ্গলে এ বার নাসার রোভারের সঙ্গে পাঠানো হেলিকপ্টার প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতের বলরামকেই।

বলরাম বললেন, ‘‘সেটা ২০১৪। আমাদের জেপিএল-এর অধিকর্তা তখন চার্লস এলাচি। তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে গিয়েছিলেন ওই সময়। সেখানে ছোট ছোট ড্রোন ও হেলিকপ্টারের নিত্যনতুন ব্যবহারের ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেই সব এলাচির বেশ ভাল লেগেছিল। জেপিএল-এ ফিরেই তিনি আলোচনা করতে শুরু করেন মঙ্গলে এমন কিছু কি পাঠানো সম্ভব? তখন আমারই এক সতীর্থ এলাচিকে বলেন, অনেক বছর আগে এমন ভাবনাই ভেবেছিলেন বলরাম। তা শুনে এলাচি আমাকে ডেকে পাঠান। মার্স ২০২০ রোভারে কী কী পাঠানো যেতে পারে তা নিয়ে নতুন একটি গবেষণাপত্র আমাকে লিখে ফেলতে বলেন এলাচি। সময় দেন ১০ সপ্তাহ। আড়াই মাস। সেই শুরু। সতীর্থদের নিয়ে মাত্র ৮ সপ্তাহের মধ্যেই লিখে ফেলি সেই গবেষণাপত্র। তার পর কাজ এগিয়ে যায় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।’’

বলরাম জানালেন, এই প্রথম ইনজেনুইটি নামে যে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছে লাল গ্রহে, স্বপ্ন দেখার শুরুতে সেই হেলিকপ্টারের আকার ও ওজন অনেকটাই কম ভাবা হয়েছিল। কারণ একটাই। মঙ্গলে বায়ুমণ্ডল প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানকার বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব আমাদের বায়ুমণ্ডলের মাত্র ১ শতাংশ। বেশি ভারী ও আকার বড় হলে লাল গ্রহের অত্যন্ত পাতলা বায়ুমণ্ডলে সাঁতার কেটে কী ভাবেই বা উড়বে সেই হেলিকপ্টার? তেমন প্রযুক্তিও ছিল না তখন সভ্যতার হাতে। তাই ভাবা হয়েছিল সেই হেলিকপ্টারের আকার হবে বড়জোর আমাদের এক টাকার কয়েনের মতো। ওজনও তথৈবচ।

কিছুতেই ভাঙতে চাইলেন না তাঁর ‘জে বব বলরাম’ নামের গোড়ার অক্ষরটির রহস্য। শুধু বললেন, ‘‘জে আমার বাবার নামের আদ্যক্ষর। তবে আমেরিকায় এসে বব নামটি হয়েছে ভাববেন না যেন। বব আমার পারিবারিক মধ্য-নাম।’’

বলরামকে যেমন নাসার প্রায় সকলেই এখন ‘বব’ নামে ডাকেন, তেমনই সমান জনপ্রিয় তাঁর স্ত্রী স্যান্ডি।

বলরাম বললেন, ‘‘উনি সব সময়েই আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। জুগিয়ে চলেছেন। তাই নাসায় ওঁকে সকলে ডাকে ‘সিএমও’ নামে। চিফ মর‌্যাল অফিসার আমার, আমাদের গোটা প্রকল্পেরও। আমার সহকর্মীদের জন্য রোজই নানা রকমের সুস্বাদু খাবারদাবার বানিয়ে দেন আমার স্ত্রী।’’

তাঁর নিজের ‘মর‌্যাল’টাও গোপন রাখেননি বলরাম।

সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ পর্বে বললেন, ‘‘জানেন, ভাল কাজ, ভাল ভাবনা কখনও মরে যায় না। ছাইচাপা পড়ে না। তার স্বীকৃতি পেতে শুধু একটু বেশি সময় লাগে। সেটা খুব একটা চটজলদি হলে ভাল কাজ, ভাল ভাবনার গুরুত্বই থাকে না যে!’’

বলরাম যে নিজেও হারতে হারতেই জিতেছেন! শেষমেশ জয় হল বলরামেরই। পৃথিবীতে রাইট ভাইদের প্রথম উড়ানের একশো বছর পর ভারতের বলরামের জন্যই তো এই প্রথম সৌরমণ্ডলের আরও একটি গ্রহে উড়তে চলেছে সভ্যতার পাঠানো ৪ পাউন্ড ওজনের হেলিকপ্টার।

ভিন গ্রহে উড়ানের ‘জনক’ হিসাবেই ইতিহাসে জায়গা করে নিলেন বেঙ্গালুরুর বব বলরাম।

ছবি ও গ্রাফিক-তথ্য সৌজন্যে: জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি, এমস রিসার্চ সেন্টার ও ল্যাংলে রিসার্চ সেন্টার, নাসা।

আরও পড়ুন
Advertisement