Greenhouse Gas Emissions

Green Electricity: বাতাসের বিষ থেকেই পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ! অভিনব উদ্ভাবন ব্যারাকপুরের প্রীতমের

গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’-এ। গবেষকদলে রয়েছেন স্ট্যানফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টার, টোকিয়ো ও কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিশ্বের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়।

Advertisement
সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২১ ১৪:৪২
-ফাইল ছবি।

-ফাইল ছবি।

কয়লা পুড়ছে না। পোড়াতে হচ্ছে না প্রাকৃতিক গ্যাসও। তাই বিষিয়ে যাচ্ছে না প্রকৃতি, পরিবেশ। কিন্তু বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে।

যা আরও চমকপ্রদ তা হল, পরিবেশকে উষ্ণ করা ছাড়া যা দিয়ে আর কোনও কাজই হয় না, সেই কলকারখানার বর্জ্য তাপ দিয়েই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন হচ্ছে।

Advertisement

বর্জ্য তাপ থেকে সেই পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের একটি নতুন পথের হদিশ দিলেন ব্যারাকপুরের সন্তান প্রীতম সাধুখাঁ।

কলকারখানা থেকে নির্গত তাপশক্তি থেকে অনেক কম খরচের সহজলভ্য পদার্থ দিয়েই এই পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করা যাচ্ছে।

স্ট্যানফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টার-সহ ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা

গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’-এ। গবেষকদলে রয়েছেন আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের টোকিয়ো ও কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিশ্বের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন বিজ্ঞানী। বঙ্গসন্তান প্রীতমই মূল গবেষক।

গ্রিনহাউস গ্যাসের বিপদ, বিকল্প পথের হদিশ

বিদ্যুৎ-সহ অন্যান্য শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমাণে কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হয় বিশ্বজুড়ে। প্রতি মুহূর্তে। তার ফলে, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো বিভিন্ন ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হয়। যা প্রতি মুহূর্তে বিষিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি, পরিবেশকে। বিষে ভরিয়ে দিচ্ছে বায়ুমণ্ডলকেও।

রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)’-এর অগস্টের রিপোর্ট জানাচ্ছে, বিশ্বে ফিবছর যে পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হয়, তার দুই-তৃতীয়াংশই তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ-সহ নানা ধরনের শক্তি উৎপাদন করতে গিয়ে। এই সব গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন যেমন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে উত্তরোত্তর বিষিয়ে তুলছে, তেমনই তা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়নেরও। যা সভ্যতার বিপদ ক্রমশ বাড়াচ্ছে।

তাই কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস না পুড়িয়েও যাতে অন্য ভাবে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ ও নানা ধরনের শক্তি উৎপাদন করা যায়, সে জন্য গত এক-দু’দশক ধরেই নানা প্রচেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়ে। পরিবেশের বিষকে ব্যবহার করেই যাতে বদলে দেওয়া যায় পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনে, সে চেষ্টাও চলছে।

প্রীতমের গবেষণার অভিনবত্ব

সেই প্রচেষ্টার নবতম সংযোজন প্রীতমদের গবেষণা। প্রীতম ও তাঁর সতীর্থ গবেষকরা একেবারেই নতুন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন শিল্প কলকারখানার বর্জ্য তাপশক্তিকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করে। আর সেটা করতে গিয়ে তাঁরা বানিয়েছেন লোহা ও কোবাল্টের একটি জৈব যৌগের কেলাস (‘ক্রিস্টাল’)। তার মাধ্যমে শিল্প কারখানার বর্জ্য তাপশক্তি থেকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য প্রীতম ও তাঁর সতীর্থরা আশ্রয় নিয়েছেন ন্যানো-টেকনোলজির। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ‘ম্যানিপুলেটিং ইলেকট্রন রিডিস্ট্রিবিউশন টু অ্যাচিভ ইলেকট্রনিক পাইরোইলেকট্রিসিটি ইন মলিকিউলার ক্রিস্টাল্‌স’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “কোনও জৈব যৌগের কেলাস ব্যবহার করে বর্জ্য তাপশক্তি থেকে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা।”

বর্জ্য তাপশক্তি বলতে কী বোঝায়?

কোনও যন্ত্র যে কোনও ধরনের শক্তি উৎপাদন করতে গিয়ে তাপশক্তির জন্ম দেয়। সেই তাপ যেমন যন্ত্রকে গরম করে তেমনই তা উষ্ণ করে তোলে আশপাশের বাতাস, পরিবেশকেও। কোনও যন্ত্রের পরিবর্তে কোনও পদ্ধতির মাধ্যমে শক্তি তৈরি হলেও উৎপন্ন হয় তাপশক্তি। এটাকেই বলে ‘ওয়েস্ট হিট’ বা বর্জ্য তাপশক্তি। একে ‘সেকেন্ডারি হিট’ বা ‘লো-গ্রেড হিট’-ও বলা হয়।

বর্জ্য তাপশক্তি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে তৈরি হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে। গাড়ির ইঞ্জিনে। তেল সংশোধনাগার ও ইস্পাত তৈরির কেন্দ্রগুলিতেও বর্জ্য তাপশক্তি উৎপন্ন হয় প্রচুর পরিমাণে।

কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে প্রীতম সাধুখাঁ। -নিজস্ব চিত্র।

কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে প্রীতম সাধুখাঁ। -নিজস্ব চিত্র।

পাইরোইলেকট্রিসিটি বলতে কী বোঝায়?

পাইরোইলেকট্রিসিটির ‘পাইরো’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। অর্থ, আগুন। তাপশক্তিকে বোঝাতে কথাটি ব্যবহৃত হয়।

শিল্প, কলকারখানার বর্জ্য তাপশক্তি থেকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনে এখন বিশ্বজুড়েই নানা রকম যৌগের বিশেষ একটি ধর্মের (‘ফেরোইলেকট্রিসিটি’) ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রে বাইরে থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী বিদ্যুৎ ক্ষেত্র বা চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। দরকার হয় অতি উচ্চ তাপমাত্রারও। তার ফলে পরিকাঠামোর খরচ অনেক বেড়ে যায়। সেই পদ্ধতিকে খুব অল্প পরিসরের মধ্যে ব্যবহার করাও যায় না।

প্রীতমদের গবেষণার অভিনবত্ব, তাঁরা এই প্রতিবন্ধকতাগুলি দূর করে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের পথ দেখাতে পেরেছেন।

প্রীতমের বানানো কেলাস আর তার কাজ

জাপানের দক্ষিণে কিউশু দ্বীপের ফুকুওকা শহর থেকে প্রীতম ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে বললেন, “আমরা লোহা ও কোবাল্টের জৈব যৌগের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র কেলাস বানিয়েছি। লোহা ও কোবাল্ট এই দু’টি মৌলই প্রকৃতিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। তাই এই কেলাস বানানোর উপকরণ পাওয়া যায় অনায়াসেই। বাড়তি সুবিধা, এই কেলাস দিয়ে বর্জ্য তাপশক্তি থেকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য বাইরে থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বা চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করতে হয় না। প্রয়োজন হয় না অতি উচ্চ তাপমাত্রারও। ফলে, পরিকাঠামোর খরচ অনেকটাই কমে যায়।”

এই ভাবে অনেক কম খরচে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য একটি অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন প্রীতমরা।

আমরা জানি, বাইরে থেকে তাপশক্তি বা চাপ প্রয়োগ করলে কোনও মৌলের পরমাণুর একেবারে বাইরের খোলক (‘আউটারমোস্ট শেল’)-এ থাকা ইলেকট্রন কণা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তার ফলে সেই সব কণা তখন আর মৌলের পরমাণুর বাইরের খোলকে থাকে না। খোলক ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।

প্রীতম জানাচ্ছেন, কলকারখানার বর্জ্য তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁদের বানানো কেলাসে থাকা লোহা ও কোবাল্টের পরমাণুগুলির বাইরের খোলকের ইলেকট্রনগুলিকে উত্তেজিত করতে। তার ফলে, বহু ইলেকট্রন মুক্ত হয়ে চলাচল শুরু করে। আর তারই জন্য জন্ম হয় বিদ্যুৎপ্রবাহের।

“এই গবেষণার আরও একটি অভিনবত্ব রয়েছে। তা হল, জৈব যৌগের কেলাসের আকার। চালের দানার চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র (এক মিলিমিটারের অর্ধেক) ওই কেলাস ৩ থেকে ৪ ইউনিট বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে পারে। কেলাসের আকার বাড়ালে বা পাশাপাশি এমন ক্ষুদ্র কেলাস অনেকগুলি রাখলে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন বেড়ে যাবে আরও অনেক গুণ।

ফলে, বড় শিল্পক্ষেত্র, বা বড় কলকারখানাগুলির যন্ত্র থেকে যে পরিমাণ বর্জ্য তাপশক্তি বেরিয়ে আসে, তা দিয়ে কী বৃহৎ পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব, তা সহজেই অনুমেয়”, বলেছেন প্রীতম।

গবেষকরা এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ‘পাইরোইলেকট্রিক ন্যানো-জেনারেটর’।

গ্রাফিক সৌজন্যে- প্রীতম সাধুখাঁ।

গ্রাফিক সৌজন্যে- প্রীতম সাধুখাঁ।

ব্যারাকপুর থেকে কিউশু

ব্যারাকপুরের সন্তান প্রীতম মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে। তার পর উচ্চমাধ্যমিক ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে। এর পরেই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে প্রীতম চলে যান মধ্যপ্রদেশে। ভোপালের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার ভোপাল) থেকে রসায়নশাস্ত্র নিয়ে করেন বিএসসি এবং এমএসসি। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পর পিএইচ ডি-র জন্য ডাক পেয়ে যান জাপানের দক্ষিণ প্রান্তের দ্বীপের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ডিন, রসায়নবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এটি একটি অভিনব গবেষণা। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্র, ছোট, বড় ও মাঝারি সব ধরনের কলকারখানাতেই যন্ত্র কাজ করে। তাপগতিবিদ্যা বলে, কেউ কাজ করলেই তাপশক্তির জন্ম হয়। যেমন আমরা পরিশ্রম করলে ঘামি। গা গরম হয়ে যায়। কলকারখানার যন্ত্র চালানোর ফলে যে বর্জ্য তাপশক্তির জন্ম হয়, তা আশপাশের বাতাসে গিয়ে মেশে। এতে তাপশক্তি নষ্ট তো হয়ই, আশপাশের বাতাসও উষ্ণ হয়ে পড়ে। নানা ধরনের রাসায়নিক থাকায় কলকারখানার যন্ত্র যে বর্জ্য তাপশক্তির জন্ম দেয়, তা পরিবেশকেও বিষিয়ে তোলে।

সুব্রতর কথায়, “যে কোনও শক্তি সব সময়ই দুর্মূল্য। তাই বর্জ্য তাপশক্তিই বা কেন অযথা নষ্ট হবে? সেই তাপশক্তির বিষাক্ত ছোবল থেকে কেন বাঁচানো যাবে না পরিবেশকে? প্রীতমের গবেষণা এই দু’টি প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পেরেছে। নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছে বর্জ্য তাপশক্তিকে। তার বিষের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছে পরিবেশকেও। আবার সেই বর্জ্য তাপশক্তি দিয়েই খুব কম খরচে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের পথ দেখিয়েছে।”

সুব্রত জানিয়েছেন, এই প্রযুক্তি যাতে সহজে, কম খরচে ব্যবহার করা যায়, তারও পথ দেখাতে পেরেছেন গবেষকরা। কেলাস দিয়ে বর্জ্য তাপশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে বদলে দেওয়ার জন্য গবেষকদের বাইরে থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বা চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করতে হয়নি। তাতে খরচ তো কমেছেই, পরিবেশও রক্ষা পেয়েছে। কারণ বাইরে থেকে সেই অত্যন্ত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বা চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি কাজ করার ফলেও তো বর্জ্য তাপশক্তির জন্ম হত।

বর্জ্য তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের প্রচেষ্টায় প্রীতম ও তাঁর সতীর্থদের গবেষণা পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে আগামী দিনে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

গ্রাফিক সৌজন্যে- প্রীতম সাধুখাঁ, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।

Advertisement
আরও পড়ুন