চাঁদের চারদিকে পাঁচটি কক্ষপথে পাক খাবে চন্দ্রযান-৩। ছবি: পিটিআই।
শনিবার সন্ধ্যায় চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর তৈরি চন্দ্রযান-৩। মহাকাশযানটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান আগেই কাটিয়ে ফেলেছিল। উৎক্ষেপণের ২২ দিন পর চাঁদের আকর্ষণবলের অধীনে প্রবেশ করেছে সেটি। তবে মূল গন্তব্যে পৌঁছতে এখনও অনেকটা ‘পথ’ পেরোনো বাকি। চাঁদের মাটি ছোঁয়ার আগে বেশ কয়েকটি কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে চন্দ্রযান-৩-কে।
শনিবার চন্দ্রযান-৩-কে চাঁদের কক্ষপথে সফল ভাবে পৌঁছে দেওয়ার পর ইসরোর তরফে একটি বিবৃতি জারি করা হয়। সেখানেই বলা হয়েছে, সন্ধ্যা ৭.১২ মিনিটে মহাকাশযানটিকে চাঁদের কক্ষপথে ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। মোট ১৮৩৫ সেকেন্ডের চেষ্টায় তা সফল ভাবে করা গিয়েছে। চাঁদের আকর্ষণবলের আওতায় বর্তমানে চন্দ্রযান-৩-এর অবস্থান ১৬৪ কিমি X ১৮০৭৪ কিমি কক্ষপথে। চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রেখেছিলেন আমেরিকার মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং। ঘটনাচক্রে, শনিবারই ছিল তাঁর ৯৩তম জন্মবার্ষিকী।
চাঁদের আকর্ষণবলের সাহায্যে এ বার তার চারপাশে পাক খাবে চন্দ্রযান-৩। ধীরে ধীরে তার গতি কমবে। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের শক্তি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে ছয় গুণ কম। সেই কারণেই ধীরে ধীরে গতি কমাতে হবে চন্দ্রযান-৩-কেও।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের অধীনে যত দিন চন্দ্রযান-৩ ছিল, তত দিন ধাপে ধাপে তার কক্ষপথ এবং গতি বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। পাঁচটি ধাপের কক্ষপথ পেরিয়ে পৃথিবীর টান ছাড়িয়েছে মহাকাশযান। কিন্তু চাঁদের ‘দেশে’ প্রক্রিয়াটি কিছুটা উল্টো। এ বার এক দিকে যেমন গতি কমবে, অন্য দিকে তেমন ধাপে ধাপে বৃহত্তর থেকে ক্ষুদ্রতর কক্ষপথে পৌঁছবে চন্দ্রযান-৩। এ ক্ষেত্রেও ইসরোর পরিকল্পনায় পাঁচটি কক্ষপথ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া রয়েছে।
চন্দ্রযান-৩-এর প্রাথমিক গন্তব্য চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে। তার পরেই চন্দ্রাভিযানের ‘সবচেয়ে কঠিন পর্ব’টি অপেক্ষা করে আছে ইসরোর জন্য। সেটাই হতে চলেছে কঠিনতম পরীক্ষা। আগামী ২৩ অগস্ট বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে রোভার প্রজ্ঞানকে পেটের ভিতরে নিয়ে ‘পাখির পালকের মতো অবতরণ’ (সফট ল্যান্ডিং) করার কথা চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের। চার বছর আগে ঠিক ওই পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়েছিল ইসরোর ‘চন্দ্রযান-২’।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামার কথা চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রমের। সেই অভিযান যদি সফল হয়, তবে ভারতের মহাকাশ গবেষণা নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা পাবে। আমেরিকা, রাশিয়া, চিনের পরে চতুর্থ দেশ হিসাবে মহাকাশযান সফল ভাবে চাঁদে অবতরণ করানোর তালিকায় উঠে আসবে ভারত।
২০১৯ সালের ৭ জুলাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে ‘সিমপেলিয়াস এন’ এবং ‘ম্যানজিনাস সি’ নামে দু’টি গহ্বরের মাঝখানে ‘চন্দ্রযান-২’ থেকে ল্যান্ডার বিক্রম অবতরণের চেষ্টা করেছিল (এ বারও অবতরণ হবে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলেই)। কিন্তু তা সফল হয়নি। পেটের মধ্যে রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে অবতরণের তিন মিনিট আগে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল বিক্রম। মাস তিনেক ধরে বিক্রমের ধ্বংসাবশেষের অনবরত খোঁজ চালিয়েছিল আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। কিন্তু কোনও ভাবেই তা চিহ্নিত করতে পারেনি তারা। শেষমেশ ‘লুনার রিকনাইস্যান্স অরবিটার’ (এলআরও)-এর তোলা একটি ছবি শেয়ার করে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য চায় নাসা। সেই ছবি দেখে চেন্নাইয়ের এক জন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিক্রমের ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন।
এটি ইসরোর চাঁদে মানুষহীন অভিযানগুলির মধ্যে তৃতীয়। এর আগেও দু’বার চন্দ্রযানকে সফল ভাবে চাঁদের কক্ষপথে পাঠিয়েছিল ভারতীয় সংস্থা। এক বার তাদের মহাকাশযান প্রবেশ করেছিল মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথেও। বেঙ্গালুরুর অফিস থেকে চন্দ্রযান-৩-এর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। চাঁদের মাটি ছোঁয়ার প্রক্রিয়াটিতে সফল হলেই তৈরি হবে ইতিহাস।
গত ১৪ জুলাই দুপুর ২টো ৩৫ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস সেন্টারের ‘লঞ্চিং প্যাড’ থেকে সফল উৎক্ষেপণ হয়েছিল ‘চন্দ্রযান-৩’-এর। এখনও পর্যন্ত মোট যাত্রাপথের দুই তৃতীয়াংশ অতিক্রম করেছে সে। কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করে আছে বাকি পথটুকুতেই। ইসরোর চন্দ্রযান কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে? সে দিকেই নজর রেখেছে গোটা দুনিয়া।