Poila Baisakh 2024

গরমকালে গ্রামবাংলায় হয় মাছ-সব্জির টক! নববর্ষে রইল তিন জেলার তেমন তিন রান্নার প্রণালী

পৃথিবীর সব শিক্ষাকে ছাপিয়ে যায় আমাদের হেঁশেলঘরের ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞান। স্বাদের সূত্রে যা বেঁধে রাখে আসমুদ্র হিমাচলের সব মায়েদের। এ বার না হয় নববর্ষের থালা সাজিয়ে তুলুন গ্রামবাংলার মায়েদের রেসিপি দিয়ে তৈরি ভিন্ন স্বাদের টকের আয়োজনে।

Advertisement
সায়ন্তনী মহাপাত্র
সায়ন্তনী মহাপাত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৩৭
Summer friendly Bengali recipes you can make for Bengali New Year

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

এই ক’দিন আগেও রান্নাঘর ছিল কেবল মেয়েদের জায়গা। কালিঝুলি মাখা স্যাঁতসেঁতে একটি ঘর, যেখানে মেয়েরা মুখ বুজে দু’বেলা উনুন ঠেলবে আর ভাতের থালা সাজিয়ে দেবে আপামর সংসারের সামনে। ইচ্ছা হোক বা না হোক। মায়ের জাত তো! মেয়েরা দিনের পর দিন সে কাজ করেছে ভালবেসে। আসলে দায়িত্বের শিকলে বেঁধে তাঁদের ইচ্ছার স্বীকৃতি সমাজ সহজে দেয়নি। তাই নিজের মনখানা তোরঙ্গে তুলে ওই আলো-আঁধারি মাখা হেঁশেলেই তাঁরা গড়ে তুলেছে এক আশ্চর্য শিক্ষার জগৎ। সেই জগতে স্মৃতি আর স্বাদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞানের অশেষ জ্ঞান। রান্না নিয়ে একটু পড়াশোনা করলে জানবে, এখনকার সুপার ফুড হোক অথবা পশ্চিমের স্লো ফুড মুভমেন্ট, নতুন বলে যা কিছুই বাজারে জনপ্রিয় হচ্ছে, তার সূত্রটুকু কিন্তু লুকিয়ে আছে আমাদের মা-ঠাকুরমাদের অতি পুরাতন সেই হেঁশেলেই।

Advertisement

অলস দিনে আমি কেবল আশ্চর্য হয়ে ভাবি, স্কুলে না যাওয়া, পুঁথি না পড়া আমার দিদিমা কেবল পারিবারিক পরম্পরায় কেমন করে আয়ত্ত করলেন শারীরতত্ত্বের এই সূক্ষ্ণজ্ঞান, গাছ-পাতা-কন্দের এমন রাসায়নিক ব্যাখ্যা! আর তার পর কোন কৌশলেই বা স্বাদ আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে তৈরি হল ঋতু অনুযায়ী রান্নার এই নানা পাককৌশল! হয়তো বা আমার সেই ভাবনার শেষে লুকিয়ে আছে বহু রাত জাগা কোনও চিন্তিত মায়ের মুখ। সকাল হলে ছেলের কাশি কমাতে কখনও সেই মা বাসক পাতার শুক্তো রাঁধেন, তো কখনও ছেলের জ্বর সারানোর জন্য দিনের শেষে রাঁধেন শটির পালো (একটি কন্দর শুকনো গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ভেষজ দাওয়াই)। সন্তানের জন্য যুগে যুগে তাঁরা রান্নাঘরের আনাচকানাচেই খুঁজে নিয়েছেন ভাল থাকার হালহদিশ আর তার পর মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

এ অবধি পড়েই যদি তুমি ভাবো রান্না কেবল এই বিজ্ঞানের আখ্যান, সে বাপু তোমার ভারী ভুল হবে! রান্নাঘরের মানচিত্রখানা ওই জালকাটা জাফরির দেরাজ আর উনুন পার করে কেমন করে সারা পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে সে তুমি ভাবতেও পারবে না। তাই তো চৈত্রের এই শেষ বেলায় রাঢ় বাংলার ঘরে ঘরে আয়োজন শুরু হবে টক রান্নার। ভারী সাধারণ সে রান্না কিন্তু এর আয়োজন চলে সারা বছর জুড়ে। পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে মেদিনীপুরের ঘরে ঘরে চলবে নুন মাখানো আম রোদে শুকোনোর প্রস্তুতি। সারা বছরের জন্য আমচুর তৈরির জোগাড়। সাত দিন ধরে নুন-জল আর প্রখর রোদে শুকনো হতে হতে সে আমের সারা শরীর জুড়ে যখন নুনের সাদা আঁকিবুঁকি ফুটে উঠবে, তখন স্বস্তি পাবেন মায়েরা। মাটির হাঁড়িতে তুলে রাখলে সে আমচুর ভাল থাকবে বছরের পর বছর। তা দিয়ে তুমি তখন মাছ রান্না করো, চাটনি বানাও কিংবা ডাল। রাঢ় বাংলার এই শুকনো, আগুন ঝরা দুপুরে ভাতের পাতে খানিক টক না থাকলে যে মুখের স্বাদ আর শরীর কিছুই টিকবে না। তাই তো শাস্ত্রেও বলা হয়েছে, ‘‘অম্লরস ভক্ত্যাং রোচয়তি, অগ্নি দীপয়তি, দেহং বৃংহয়তি ঊর্যয়তি, মনো বোধয়তি, ইন্দ্রিয়াণি দ্রাঢিকরোতি, বলং বর্ধয়তি’’ (চরক সংহিতা, সূত্র ২৬/৪৩)। এর অর্থ হল, অম্ল রস রুচি ও ক্ষুধাবর্ধক, অগ্নি উদ্দীপনকারী, শরীরে শক্তি জোগায়, মনকে জাগ্রত করে, ইন্দ্রিয়গুলিকে দৃঢ় করে এবং বলবর্ধকও বটে।

মঙ্গলকাব্যের পাতায় পাতায় তাই ছড়িয়ে আছে হরেক টকের বর্ণনা। শুধু কি তা, রাঢ় বাংলার বিভিন্ন মন্দিরের পুজোয় দেবদেবীর ভোগেও নিত্য নিবেদন করা হয় নানা মাছের টক।

বীরভূমের মাটির দাওয়ায় ওই দেখেন, ময়নার পাতে নালতে শাকের ঝোলের পাশে মা বেড়ে দিচ্ছেন এক বাটি গরমের সব্জি দিয়ে রান্না করা মোটা টক। খানিকটা আলুর সঙ্গে লঙ্কা ডলে দিলে মেয়ে কেমন হাপুস হুপুস খায়, সে দেখেও মায়ের শান্তি।

বাঁকুড়ার মানদার হেঁশেলেও তত দিনে তেঁতুল জারানো শেষ। মাটির হাঁড়িতে, নুনের পরতে পরতে সেজে সেই তেঁতুল উঠে গিয়েছে অন্ধকার ভাঁড়ারে। বালি বিছানো তাকে সাজিয়ে রাখা সেই তেঁতুল এখন টিকবে বহু বছর। যত পুরনো হবে, রং হবে তত মসীবর্ণ, বাড়বে এর ঔষধিগুণ। অজীর্ণ, রুচিহীনতার মহৌষধ এই কালো তেঁতুল দিয়ে ঠাকুরমার মতো করে কুচো মাছের টক রাঁধেন মানদা। উপর থেকে ছড়িয়ে দেন খানিক ভাজা জিরে আর শুকনো লঙ্কার ফোড়ন। সারা সকাল মাঠে মাঠে কাজ করে, শেষ পাতের ভাতে এই টক মেখে নিতে নিতে যখন বাপমরা ছেলে মুখ তুলে চায়, তখন মায়ের চোখ ভরে আসে জলে। ছেলেমানুষ সে, খাবে কেবল স্বাদের লোভে, কিন্তু শরীর-স্বাস্থ্য মেনে, ঋতুচক্রের হিসাবে বুঝে তার পাতে সঠিক খাবার তুলে দেওয়ার সব চেষ্টা যে কেবল মায়ের।

আর ঠিক এখানেই, পৃথিবীর সব শিক্ষাকে ছাপিয়ে যায় আমাদের হেঁশেলঘরের ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞান। সন্তানের জন্য, স্বাদের সূত্রে, যা বেঁধে রাখে আসমুদ্র হিমাচলের সব মায়েদের।

এ বার না হয় নববর্ষের থালা সাজিয়ে তুলুন হরেক স্বাদের টকের আয়োজনে।

মেদিনীপুরের আমচুর

Summer friendly Bengali recipes you can make for Bengali New Year

ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।

উপকরণ:

৪টি রুই মাছ

৩টি আমচুর

২ টেবিল চামচ সর্ষে বাটা

১/২ চা চামচ পাঁচফোড়ন

২টি শুকনো লঙ্কা

৬-৮ টুকরো কুমড়ো

২-৩টি কাঁচা লঙ্কা

স্বাদমতো নুন

সামান্য হলুদ

প্রয়োজন অনুযায়ী সর্ষের তেল

প্রণালী:

আমচুরের নুন এক বার ধুয়ে ভিজিয়ে রাখুন এক কাপ জলে।

রুই মাছে নুন-হলুদ মাখিয়ে হালকা করে তেলে সাঁতলে নিন।

কড়াইয়ে তেল গরম করে তাতে পাঁচফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা দিন, সুগন্ধ বেরোলে কুমড়ো দিয়ে দিন। নুন-হলুদ দিয়ে আধ ভাজা করুন।

এক কাপ জলে সর্ষে গুলে কড়াইয়ে ঢেলে দিন। ঢাকা দিয়ে রান্না করুন ৪-৫ মিনিট। আমচুর সামান্য চটকে জল-সহ দিয়ে দিন কড়াইয়ে। ঝোল ফুটে উঠলে মাছ আর কাঁচা লঙ্কা দিন। নুন দিন স্বাদমতো।

ভাল করে ফুটিয়ে পরিবেশন করুন গরম ভাতের সঙ্গে।

বাঁকুড়ার তেঁতুল দিয়ে মৌরলা মাছের অম্বল

Summer friendly Bengali recipes you can make for Bengali New Year

ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।

উপকরণ:

২০০ গ্রাম মৌরলা মাছ

১৫-২০ টুকরো কুমড়ো (সরু কুচি করে কাটা)

১ মুঠো শুকনো তেঁতুল

১/২ চা চামচ গোটা সর্ষে

২টি শুকনো লঙ্কা

২টি কাঁচা লঙ্কা

প্রয়োজন অনুসারে তেল

স্বাদমতো নুন, হলুদ আর চিনি

প্রণালী:

তেঁতুল জলে ভিজিয়ে রাখুন। তার পর চটকে ক্বাথ বার করে নিন।

মাছে নুন-হলুদ মাখিয়ে হালকা করে ভেজে তুলে নিন।

কড়াইয়ে এক চামচ তেল দিয়ে ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা দিন। ফুটে উঠলে কুমড়ো আর নুন-হলুদ দিয়ে আধ ভাজা করুন। তেঁতুলের ক্বাথ দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিন। সামান্য জল দিয়ে ফুটতে দিন।

ঝোল ফুটে উঠলে মাছ দিয়ে মাঝারি আঁচে ঢাকা দিয়ে ফোটান আরও ৩-৪ মিনিট। এ বার দিন স্বাদমতো চিনি আর চেরা কাঁচা লঙ্কা।

ঝোল খানিকটা ঘন হয়ে এলে গ্যাসের আঁচ বন্ধ করে পরিবেশন করুন ভাতের সঙ্গে।

বীরভূমের মোটা টক

Summer friendly Bengali recipes you can make for Bengali New Year

ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।

উপকরণ:

প্রয়োজন মতো আলু, বেগুন, মুলো, কুমড়ো, কচু

১ মুঠো ডালের বড়ি

২ টেবিল চামচ সর্ষে বাটা

১/৩ কাপ তেঁতুলের ঘন ক্কাথ

১/২ চা চামচ পাঁচফোড়ন

২টি শুকনো লঙ্কা

৪-৫টি কাঁচা লঙ্কা

প্রয়োজন মতো সর্ষের তেল

প্রণালী:

সব্জির খোসা ছাড়িয়ে লম্বা করে কেটে আলাদা আলাদা করে রাখুন।

কড়াইয়ে তেল গরম করে বড়ি লাল করে ভেজে তুলে রাখুন।

আবার ২ টেবিল চামচ তেল দিয়ে প্রথমে মুলো আলু কচু দিন। নুন-হলুদ দিয়ে একটু ভাজা হলে দিন কুমড়ো। সব সব্জি আধভাজা হলে বেগুন দিয়ে ভাল করে নেড়েচেড়ে নামিয়ে নিন।

কড়াইয়ে আরও খানিক তেল দিয়ে ফোড়ন আর লঙ্কা দিন। সুগন্ধ বেরোলে সব্জি দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিন। এ বার সর্ষে বাটা ২ কাপ জলে গুলে দিয়ে দিন। নুন, হলুদ, চেরা লঙ্কা দিয়ে ঝোল ফুটতে দিন আরও ৫ মিনিট। তার পর শেষে মিশিয়ে দিন তেঁতুলের ক্কাথ। প্রয়োজনে আরও খানিকটা জল দিতে পারেন।

নুন, লঙ্কা স্বাদমতো দিয়ে ভাল করে ফুটিয়ে ঘন করে নিন। নামানোর আগে ভাজা বড়ি মিশিয়ে নামিয়ে নিন।

আরও পড়ুন
Advertisement