বছরশেষে রক্তাক্ত জার্মানি। শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ভিড়ে ঠাসা বড়দিনের বাজারে বেপরোয়া গাড়ি ঢুকে পিষে দিল অন্তত পাঁচ জনকে। আহত সাত ভারতীয়-সহ মোট ৬৮ জন। ঘটনার পর সন্দেহভাজনক গাড়ির চালককে গ্রেফতার করেছে জার্মান পুলিশ। নিছক দুর্ঘটনা না কি ‘একাকী নেকড়ে’ (লোন উল্ফ) কায়দায় জঙ্গি হামলা? এরই উত্তর এখন হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন দুঁদে গোয়েন্দারা।
জার্মান পুলিশ সূত্রে খবর, বছর ৫০-এর ধৃত ব্যক্তি সৌদি আরবের বাসিন্দা। পেশায় তিনি চিকিৎসক। সমাজমাধ্যমে নিজের পরিচয় ‘তালেব এ’ হিসাবে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি। তবে তাঁর আসল নাম তালেব আল-আবদুলমোহসেন। অভিযুক্ত বর্তমানে ইসলামের কড়া সমালোচক হলেও আগে ছিলেন মুসলমান ধর্মাবলম্বী।
গোয়েন্দাদের দাবি, জার্মানির চরম ডানপন্থী দল ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা এএফডির উগ্র সমর্থক হিসাবে ধৃতের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। অভিবাসী বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আমজনতার মধ্যে ইতিমধ্যেই একটা জায়গা করে নিয়েছে এই রাজনৈতিক পার্টি। সেই আন্দোলনে অভিযুক্তের কতটা সক্রিয় যোগদান ছিল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
প্রাথমিক তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, ২০০৬ সাল থেকে জার্মানিতে থাকছেন তালেব। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সাক্সোনি-আনহাল্টের বাসিন্দা তিনি। এখানকারই একটি জায়গা হল মাগডেবুর্গ। রাজধানী বার্লিন থেকে ওই শহরের দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। সেখানেই বড়দিনের বাজারে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে বেশ কয়েক জনকে তালেব হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ।
জার্মান সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘হামলা’য় একটি কালো রঙের বিএমডব্লিউ ব্যবহার করা হয়েছে। গাড়িটি তালেবের নিজের নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে এটিকে ভাড়া করেন তিনি। যাঁরা তাঁকে গাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন, তাঁদের সন্ধান চালাচ্ছেন তদন্তকারীরা। উল্লেখ্য, হামলাকারী অভিযুক্ত মনস্তত্ত্ব এবং সাইকোথেরাপির বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। জার্মানির ছোট শহর বার্নবুর্গে চিকিৎসা করতেন তিনি।
‘হামলা’য় ব্যবহৃত গাড়িটির চালকের আসন থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করেন জার্মান তদন্তকারীরা। সেখানে সন্দেহজনক কিছু পদার্থ মিলেছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। মাদক না কি বিস্ফোরক, তা জানতে সেগুলিকে ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত মাদকাসক্ত ছিলেন কি না তা-ও জানার চেষ্টা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তালেবের কিছুটা ঠিকুজিকুষ্ঠি জেনে ফেলেছেন তদন্তকারীরা। ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের হফুফ শহরে জন্ম হয় তাঁর। ২০০৬ সালে জার্মান সরকার অভিযুক্তকে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার অনুমতি দেন। এর আরও এক দশক পর (পড়ুন ২০১৬ সাল) শরণার্থীর স্বীকৃতি পান তালেব।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদি আরবে নিজের নাস্তিক চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশে অক্ষম ছিলেন অভিযুক্ত ব্যক্তি। কারণ, পশ্চিম এশিয়ার দেশটির আইনে এর অনুমতি দেওয়া হয়নি। কঠোর ইসলামীয় রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে চলছে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা। জার্মানিতে এসে অবশ্য স্বাধীন ভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছিলেন তালেব।
বিসিসি আরও জানিয়েছে, মক্কা-মদিনার দেশ ছেড়ে মধ্য ইউরোপে চলে আসার পর একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন ওই ব্যক্তি। জার্মানিতে বসেই সেটি চালাতেন তিনি। ওয়েবসাইটির নাম হল, ‘উই আর সৌদি ডট নেট’। এর মাধ্যমে সৌদি এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলি থেকে ইসলামত্যাগীদের পালাতে সাহায্য করতেন তালেব। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতেন তিনি।
জার্মানির সংবাদমাধ্যমগুলির আবার দাবি, পশ্চিম এশিয়া থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ান ভুক্ত দেশগুলিতে (যার মধ্যে জার্মানিও পড়ে) নারী পাচার এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তালেবকে খুঁজছে সৌদি প্রশাসন। তবে এই অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রিয়াধের হাতে তাঁকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে বার্লিন। শুধু তা-ই নয়, তালেবকে আশ্রয় দিতেও পিছপা হয়নি জার্মান প্রশাসন।
বড়দিনের বাজারে ‘হামলা’র ধরন দেখে একে ‘লোন উল্ফ’ কায়দায় সন্ত্রাসী আক্রমণ বলা যায় কি না, তা নিয়ে জার্মান গোয়েন্দাদের মনে দেখা দিয়েছে ধন্দ। সূত্রের খবর, ঘটনার পর টানা জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত জানিয়েছেন, পরিকল্পনামাফিক গাড়ি দিয়ে সবাইকে পিষে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে এই কাজে তাঁর কোনও সহযোগী ছিল না।
তালেবের বিরুদ্ধে এর আগে কোনও নাশকতামূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস নেই। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন তিনি। ফলে তাঁর পরিকল্পনামাফিক ‘হামলা’র মোটিভ পরিষ্কার নয়। সৌদি থেকে আসা শরণার্থীদের প্রতি জার্মান সরকারের ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি এই কাজ করেছেন বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে ঢুকে মারাত্মক হামলা চালায় প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হামাস’। ঠিক তার আগের দিন সমাজমাধ্যমে একটি ‘উস্কানিমূলক’ পোস্ট করেন তালেব। যাঁরা সৌদি থেকে পালানোর কথা ভাবছেন, তাঁদের জার্মানিতে না-আসার পরামর্শ দেন তিনি।
সমাজমাধ্যমের পোস্টে ইউরোপের ‘ইসলামিকরণ’ হচ্ছে বলে দাবি করেন অভিযুক্ত তালেব। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে ইহুদি চরমপন্থার ছোঁয়া রয়েছে বলে মনে করেন জার্মান সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞেরা। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ ধনকুবের শিল্পপতি এলন মাস্কের বড় সমর্থক বলে জানা গিয়েছে।
সৌদি আরবে তালেবের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ রয়েছে। এ হেন ‘ওয়ান্টেড’ ব্যক্তি কী ভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় পেলেন, তা নিয়ে জার্মানিতে উঠে গিয়েছে প্রশ্ন। ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে বড়দিনের বাজারে ‘হামলা’র সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ। সেখানে পথচারীদের পিষে দিতে দিতে বেপরোয়া গাড়িটিকে অন্তত ৪০০ মিটার এগিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে।
এই ঘটনার পর সারা দেশকেই এক রকম নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলেছে জার্মানির ‘ডোমেস্টিক সিকিউরিটি সার্ভিস’। এই সংস্থার ‘অফিস ফর দ্য প্রোটেকশন অফ কনস্টিটিউশন’-এর তরফে জারি হয়েছে বিজ্ঞপ্তি। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কট্টর ইসলামপন্থীরা বড়দিনের বাজারগুলিকে নিশানা করতে পারে। সেখানে কেনাকাটা করতে আসা বা বেড়াতে আসা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’’
এর আগে ২০১৬ সালে রাজধানী বার্লিনে বড়দিনের বাজারে একই ধরনের ট্রাক হামলার ঘটনা ঘটে। সে বার বেপরোয়া ট্রাক দিয়ে ১৩ জনকে পিষে দেন সন্দেহভাজন এক সন্ত্রাসী। আট বছর পর মাগডেবুর্গে একই ঘটনার স্মৃতি ফেরায় রীতিমতো হতবাক জার্মান গোয়েন্দারা। দু’টি ঘটনার মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছেন তাঁরা।
২০ ডিসেম্বরের ঘটনার কড়া নিন্দা করে ভারত ও সৌদি আরব। অন্য দিকে এই ইস্যুতে জার্মানিতে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। চরম ডানপন্থী ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’-এর আলিসে ভাইডেলের প্রশ্ন, কবে বন্ধ হবে এই উন্মাদনা। অন্য দিকে জার্মান চ্যান্সেলার ওলাফ স্কোলৎজ় বলেছেন, ‘‘এগুলি প্রতিহত করতে আমাদের আরও সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে।’’
জার্মান অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক আবার মনে করে, হামলাকারী ইসলাম ভীতিতে ভুগছিলেন। যদিও অভিযুক্ত ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’, এ কথা মানতে নারাজ তদন্তকারীরা। গত মাসে বড়দিনের বাজারে হামলার পরিকল্পনা করা দুই কিশোরকে গ্রেফতার করে জার্মান পুলিশ। কিন্তু, তার পরও মৃত্যু ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে স্কোলৎজ় প্রশাসন।
বার্লিন ও মাগডেবুর্গই নয়, গত কয়েক বছরে একাধিক বার এই ধরনের জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে ইউরোপের একাধিক দেশ। ২০১৭ সালে জার্মানির পোটসডাম এবং ২০১৮ সালে ফ্রান্সের স্ট্রসবুর্গে বড়দিনের সময়ে গাড়ি দিয়ে পিষে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফ্রান্সের দিজ়ঁতে কার-অ্যাটাকে প্রাণ হারায় খুদে স্কুলপড়ুয়ারা। সালটা ছিল ২০১৪।
সব ছবি: সংগৃহীত।