বালুচিস্তানে জঙ্গি সংগঠন জইশ অল অদলের ঘাঁটিতে ইরানের মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার পর ইরানের উপর পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের দাবি, তারাও ‘জঙ্গি দমন’ করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হামলা এবং পাল্টা হামলার যে পর্ব দুই প্রতিবেশী ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হয়েছে, তা নিয়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ভারত, চিন থেকে শুরু করে আমেরিকা, এই সংঘাত নিয়ে নিজেদের মতপোষণ করেছে।
দ্বন্দ্ব যাই হোক না কেন, কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, প্রতিবেশী হিসাবে মোটে ভাল নয় পাকিস্তান।
২০০৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘‘আমরা বন্ধু পাল্টাতে পারি কিন্তু প্রতিবেশী নয়।’’ কারণ, তা সম্ভবও নয়। তবে কূটনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, একটি সুযোগ দেওয়া হলে প্রতিবেশী হিসাবে পাকিস্তানকে বাদ দিতে কোনও দেশই পিছপা হবে না! কিন্তু কেন এমন পর্যবেক্ষণ কূটনীতিকদের?
তার মধ্যেও বাকি প্রতিবেশীদের তুলনায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের থেকে খাদ্য, পণ্য, ওষুধ এবং শিল্প ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি করে পাকিস্তান। কিন্তু ভারত বার বার অভিযোগ করেছে পাকিস্তান ‘রফতানি করে’ সন্ত্রাস।
ভারতকে না হয় বাদই দেওয়া গেল, বাকি প্রতিবেশীদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কেমন?
আফগানিস্তান এবং ইরানের সঙ্গেও আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভাগ করে নেয় পাকিস্তান। ইরান ও আফগানিস্তান— উভয়ই মুসলিম ধর্মাবলম্বী দু’টি দেশ। পাকিস্তানের মতো, আফগানিস্তানে সুন্নি মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হলেও ইরানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া মুসলিমরা।
কিন্তু কোনও প্রতিবেশীর সঙ্গেই পাকিস্তানের সৌহার্দ্য নেই। ভারত-পাক সীমান্ত মাঝেমধ্যেই অশান্ত হয়ে ওঠে। সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত।
মঙ্গলবার পাকিস্তানের বালুচিস্তানে জঙ্গি সংগঠন জইশ অল অদলের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালায় ইরান। পাকিস্তানের উপর হামলার কথা ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে তেহরান।
ইরানের বিদেশমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, ওই হামলার লক্ষ্য ছিল জঙ্গি সংগঠন জইশ অল অদল বা ‘আর্মি অফ জাস্টিস’-এর ঘাঁটি ধ্বংস করা। ২০১২ সালে তৈরি হওয়া ওই সুন্নি গোষ্ঠীকে জঙ্গি সংগঠন বলে ঘোষণা করেছে আমেরিকা এবং ইরান। ইরানের দাবি, এই জঙ্গি সংগঠনের কার্যকলাপ মূলত ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত জুড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ওই জঙ্গি গোষ্ঠী ইরানের মাটিতে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে বলেও সে দেশের দাবি। আর সেই কারণেই জইশ অল অদল সংগঠনের ঘাঁটি উচ্ছেদ করতে পাকিস্তানের ‘সবজ কোহ’ গ্রামে মঙ্গলবার হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে তেহরান।
এই হামলার পরেই গর্জে ওঠে ইসলামাবাদ। হামলায় দু’জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দেয়, ‘ফল ভুগতে হবে’ ইরানকে। ইসলামাবাদ এ-ও জানিয়েছিল, কোনও উস্কানি ছাড়াই বালুচিস্তানে হামলা চালিয়েছে ইরান এবং তা আন্তর্জাতিক আইন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতির পরিপন্থী। এর পরে বৃহস্পতিবার ইরানের উপর পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তান। এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের ‘মার্গ বার সরমাচার’ নামক ওই অভিযানে ‘বেশ কয়েক জন সন্ত্রাসবাদী’র মৃত্যু হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, সংঘাতে জড়িয়ে পড়া দুই দেশের বিরুদ্ধেই এর আগে একাধিক বার সীমান্ত এলাকায় হামলা চালায় এমন জঙ্গি গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
ইরান এবং পাকিস্তানের প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে জঙ্গি কার্যকলাপ দীর্ঘ দিন ধরেই ইসলামাবাদ এবং তেহরানের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই সীমান্তবর্তী ৯০০ কিলোমিটার এলাকা মাদক পাচার ও সন্ত্রাসবাদের মুক্তাঞ্চল বলেও বার বার অভিযোগ উঠেছে।
এই ৯০০ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে বালুচিস্তান অঞ্চল, যা উভয় দেশ জুড়ে বিস্তৃত। ওই বিস্তৃত এলাকায় আধিপত্য রয়েছে বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের। এরা দীর্ঘ সময় ধরে পৃথক বালুচিস্তানের দাবিতে বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই সংগঠনগুলির কার্যকলাপ সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার প্রধান কারণ, উভয় দেশের মধ্যে সুন্নি এবং শিয়া সংক্রান্ত সাম্প্রদায়িক বিভাজন।
ইরানের অভিযোগ, পাকিস্তান সীমান্তের দিকে থাকা সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ অল অদল দীর্ঘ দিন ধরে দক্ষিণ-পূর্ব ইরানে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
আমেরিকার এক গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্তার মতে, জইশ অল অদল ২০১৩ সাল থেকে ইরানে একাধিক হামলা চালিয়েছে। ইরানের বহু সরকারি আধিকারিককে ‘খুন এবং অপহরণের’ সঙ্গেও তারা জড়িত।
২০১৩ সালের অক্টোবরে, জইশ অল অদলের জঙ্গিরা ইরানের ১৪ জন সীমান্তরক্ষীকে হত্যা করে। ২০১৯ সালে ইরানের আধাসামরিক গোষ্ঠী, ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড-এর উপর একটি আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল। যাতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই বছর ইরানের ১৪ জন সেনাকে অপহরণের অভিযোগও রয়েছে ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
তবে শুধু ইরানের সঙ্গে নয়, প্রতিবেশী আফগানিস্তানের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক ভাল নয় বলে দাবি কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
২০২১ সালের অগস্ট মাস। তালিবান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের প্রতিবেশী আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর সেই দেশ ছাড়ছিল আমেরিকা এবং নেটো বাহিনী।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, তালিবদের উত্থান এবং আমেরিকার প্রস্থান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘আফগানরা দাসত্বের শিকল ভেঙেছে।’’ অর্থাৎ, বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি তালিবানকে সমর্থন জানিয়েছিল পাকিস্তানও।
কিন্ত কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের তালিবরা পাকিস্তানের জন্য ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ হয়ে উঠছে।
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্কের যে পতন সম্প্রতি লক্ষ্য করা গিয়েছে, তার অন্যতম কারণ হিসাবে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)’-এর কার্যকলাপকেই দেখছেন কূটনৈতিকরা।
টিটিপি একটি পাকিস্তান বিরোধী জঙ্গি সংগঠন। ইসলামাবাদের অভিযোগ টিটিপি আদ্যোপান্ত পাকিস্তান বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সমর্থন জোগায় তালিবান।
এ ছাড়াও পাকিস্তান থেকে আফগান উদ্বাস্তুদের নির্বাসন এবং আফগানিস্তানের পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের উপর ভিসা নিয়ে কড়াকড়ির জন্যও দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা গিয়েছে।
তবে আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার তালিবান সরকার গঠনের আগে সেই দেশে যে সরকার ছিল, তারাও ক্রমাগত পাকিস্তানকে জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করতে বলেছিল।
ভারতের সঙ্গেও পাকিস্তানের ‘মধুর’ সম্পর্ক বিশ্ববাসীর কাছে অজানা নয়। ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই বিষয়ে পাকিস্তানের কোনও স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও তারা ভারতের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল এবং সিদ্ধান্তটিকে ‘একতরফা’ বলে উল্লেখ করেছিল। এই নিয়ে দু’দেশের সম্পর্কে অবনতি দেখা গিয়েছিল।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) আপেক্ষিক শিথিলতা এসেছে। ভারত এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আগে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ এবং গুলি বিনিময়ে অশান্ত হয়েছিল এলওসি।
তবে সরাসরি প্রতিবেশী না হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে দহরম-মহরম দেখা গিয়েছে চিন এবং পাকিস্তানের মধ্যে। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে তারা।
ছবি: এএফপি, এক্স এবং সংগৃহীত।