কেউ তাঁকে বলেন যুদ্ধবাজ। কারও কাছে তিনি সাক্ষাৎ পিশাচ। শুধু তা-ই নয়, গত দু’বছরে ‘২১ শতকের হিটলার’-এর দুর্নামও জুটেছে তাঁর কপালে। এ হেন ভ্লাদিমির পুতিন এ বার পা রাখবেন ‘বন্ধু’ দেশ ভারতে। রুশ প্রেসিডেন্টের সেই আগমনবার্তায় আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে শুরু হয়েছে হিসাবনিকাশ।
চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর মস্কোর তরফে সরকারি ভাবে পুতিনের ভারত সফরের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়। ক্রেমলিনের প্রেসসচিব দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের নয়াদিল্লি যাওয়ার চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করা হচ্ছে। যদিও নির্দিষ্ট কোনও তারিখের কথা তিনি উল্লেখ করেননি।
এ বছরের জুলাইয়ে মস্কো সফরে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই সময়ে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। এর পরই পুতিনকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানান মোদী। উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে ‘ব্রিকস’ সম্মেলনে যোগ দিতে দ্বিতীয় বার রাশিয়ার কাজান শহরে যান তিনি। সেখানেও আলাদা করে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মোদী-পুতিন।
রাশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক’-এর নয়াদিল্লির অনুষ্ঠানে সম্প্রতি ভিডিয়োবার্তা দেন পেসকভ। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘এ বছর দু’বার প্রধানমন্ত্রী মোদীকে স্বাগত জানাতে পেরে আমরা আনন্দিত। আশা করছি খুব দ্রুত প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফরের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলতে পারব।’’
বিগত দিনের মতো রুশ প্রেসিডেন্টের এখনকার ভারত সফর মোটেই সহজ নয়। কারণ, বর্তমানে তাঁর মাথার উপর ঝুলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা। যার জেরে গত দু’বছরে উত্তর কোরিয়া এবং চিন ছাড়া দেশের বাইরে সে ভাবে পা রাখেননি মস্কোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে বিশেষ ফৌজি অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করে রুশ সেনা। তার পর থেকে হাজার দিন কেটে গেলেও পূর্ব ইউরোপে থামছে না যুদ্ধ। উল্লেখ্য, সংঘর্ষ বাধার কিছু দিনের মধ্যেই ‘বাদামি ভালুকের দেশ’টির রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পুতিনের ভারত সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। বিবদমান দু’টি দেশই মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নয়াদিল্লিকে পাশে চাইছে। আর তাই আলোচনার টেবিলে বসার আগে ‘বন্ধু’র সমর্থন নিশ্চিত করতে এ দেশে আসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
মুখে অবশ্য মোটেই সে কথা বলছে না মস্কো। রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে ফি বছর করা ভারত সফর যুদ্ধের কারণে ২০২২ সাল থেকে বন্ধ রেখেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। যা ফের এক বার চালু করতে চাইছেন তিনি।
ক্রেমলিনের জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ বছরের জুলাইয়ে ২২তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক সম্মেলন মস্কোয় আয়োজন করা হয়েছে। নিয়ম মেনে পরবর্তী শীর্ষ বৈঠক ভারতে হবে। আর তাতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
এ বছরের নভেম্বরে হওয়া ভোটে দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পরই ইউক্রেনকে কোনও রকমের অর্থ বা হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য না করার কথা ঘোষণা করেন তিনি। এত দিন যা সমানে জুগিয়ে আসছিলেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, ওয়াশিংটন থেকে হাতিয়ার ও অর্থ সরবরাহ বন্ধ হলে দ্রুত পতন হবে কিভের। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে যুদ্ধজয় এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। আর তাই বাণিজ্যিক সম্পর্ক ফের মজবুত করার পুরনো রাস্তায় ফিরে গিয়েছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার অন্যতম হল ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট)। রুবল (রুশ মুদ্রা) ও রুপিতে (ভারতীয় মুদ্রা) আমদানি এবং রফতানি নিয়ে নয়াদিল্লি ও মস্কোর মধ্যে সমঝোতা হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
পুতিনের আসন্ন ভারত সফরে বাণিজ্য যে সবচেয়ে গুরুত্ব পেতে চলেছে, ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত দিয়েছেন দিমিত্রি পেসকভ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। কৌশলগত অংশীদারির ক্ষেত্রে ভারতকে আমরা সব সময়েই আলাদা নজরে দেখে এসেছি।’’
২০২২ সালে রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার। পরের বছর যা বেড়ে ৫ হাজার ৬৭০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছয়। এ বছরের প্রথমার্ধে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ তিন হাজার কোটি ছুঁয়েছে। এই অঙ্ক ছ’হাজার কোটিতে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সফরে আসেন রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী ডেনিস মান্টুরভ। মুম্বইয়ে ভারত-রাশিয়া বাণিজ্যিক ফোরামের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে মস্কোর সঙ্গে যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি।
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে প্রতিরক্ষা চুক্তিমাফিক বেশ কিছু হাতিয়ার ভারতের হাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তুলে দিতে পারেনি রাশিয়া। সেই তালিকায় রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’, মাল্টিরোল ফ্রিগেট ও ডুবোজাহাজ। এ ব্যাপারে পুতিন-মোদী কথা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি, ‘পন্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ কেনার জন্য মস্কোর সঙ্গে মউ সই করেছে নয়াদিল্লি। চুক্তি অনুযায়ী আগামী দিনে ভারতেই তৈরি হবে এই হাতিয়ার। দ্রুত সেই কাজ শুরু করতে পুতিনের সঙ্গে যাবতীয় আলাপ সেরে নিতে পারেন মোদী।
পন্টসার একটি বহুমুখী এবং উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা বিমান ও ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে বহুস্তরীয় সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এতে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমানবিধ্বংসী কামান— এই তিন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যা উন্নত রাডার এবং ট্র্যাকিং সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। ৩৬ কিমি দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত এবং ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে পন্টসারের।
বর্তমানে যুদ্ধবিমানের সমস্যায় ভুগছে ভারত। ইতিমধ্যেই ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্র। নয়াদিল্লিকে ‘এসইউ-৭৫’ জেট এবং বোমারু বিমান ‘টিইউ ১৬০’ বিক্রির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে মস্কোর। পুতিনের আসন্ন সফরে এই নিয়েও সমঝোতা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যুক্তি রয়েছে ভারতের। নয়াদিল্লি আইসিসির সদস্য নয়। তাই এই আদালতের নির্দেশ মেনে চলতে মোদী প্রশাসন একেবারেই বাধ্য নয়। এই যুক্তিতে সব দিক রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
পুতিনের ভারত সফরের সময় নিয়েও চলছে আলোচনা। বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন গত তিন বছরে এক বারও ভারতে আসেননি রুশ প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচনে জিততেই তাঁর ভারত সফরের পথ প্রশস্ত হল বলেও মনে করছেন অনেকে।
আগামী বছর (পড়ুন ২০২৫) ‘কোয়াড’ সম্মেলনে যোগ দিতে এ দেশে আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর সফরের আগে রুশ প্রেসিডেন্টের ভারতে আসাকে কেন্দ্র করে চড়ছে পারদ। দু’জনের সফরে কূটনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে নয়াদিল্লি কতটা লাভবান হয়, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।