
২৫ ঘণ্টা বিতর্কের পর সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হয় সংশোধিত ওয়াকফ বিল। রাষ্ট্রপতি সই করায় ইতিমধ্যেই তা পরিণত হয়েছে আইনে। কিন্তু, এখনও রয়ে গিয়েছে একটি প্রশ্ন। দেশের ৩০টি ওয়াকফ বোর্ডের হাতে রয়েছে মোট কত সম্পত্তি? এর মধ্যে জমির পরিমাণই বা কতটা? বিল পাশ হওয়ার পর প্রকাশ্যে এল ওয়াকফের রাজ্যওয়াড়ি সম্পত্তির হিসাবের খতিয়ান। আর সেখানে অন্যদের অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ।

ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অফ ইন্ডিয়া (ডব্লুএএমএসআই) পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বোর্ডটির হাতে থাকা ৩৮ লক্ষ একর জমিতে ছড়িয়ে আছে ৮.৭২ লক্ষ নথিভুক্ত সম্পত্তি। এর মধ্যে ৪.০২ লক্ষ ওয়াকফ সম্পত্তি ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ব্যবহার করছেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মাত্র ৯,২৭৯টি সম্পত্তির মালিকানা ডব্লুএএমএসআইয়ের পোর্টালে আপলোড করা হয়েছে। এর মধ্যে আবার ১,০৮৩টি সম্পত্তির সুনির্দিষ্ট ওয়াকফ দলিল বা নথি রয়েছে।

ওয়াকফ সম্পত্তির রাজ্যওয়াড়ি তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে প্রথম স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। যোগীরাজ্যে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের কাছে রয়েছে ২.১৭ লক্ষ সম্পত্তি। তবে তাদের হাতে থাকা জমির সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সেখানকার শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের হাতে রয়েছে ১৫ হাজার ৩৮৬টি সম্পত্তি। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে আছে পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও তামিলনাড়ু। এই তিন রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ যথাক্রমে ৮০ হাজার ৪৮০, ৭৫ হাজার ৯৬৫ এবং ৬৬ হাজার ৯২টি।

কর্নাটক, কেরল ও তেলঙ্গানার ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তির অঙ্ক যথাক্রমে ৬২ হাজার ৮৩০, ৫৩ হাজার ২৮২ এবং ৪৫ হাজার ৬৮২। তালিকায় পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম স্থানে রয়েছে এই তিন দক্ষিণী রাজ্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর রাজ্য গুজরাত রয়েছে আট নম্বর স্থানে। পশ্চিম ভারতীয় রাজ্যটিতে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ৩৯ হাজার ৯৪০।

রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়া জম্মু-কাশ্মীরে ওয়াকফ সম্পত্তি আছে ৩২ হাজার ৫৩৩। তালিকায় ভূস্বর্গের স্থান ১১। ৯ এবং ১০ নম্বরে রয়েছে মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ। এই দুই রাজ্যে যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৭০১ এবং ৩৩ হাজার ৪৭২টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়া রাজস্থান, হরিয়ানা ও অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ যথাক্রমে ৩০ হাজার ৮৯৫, ২৩ হাজার ২৬৭ ও ১৪ হাজার ৬৮৫টি।

সবচেয়ে কম ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে দাদরা ও নগর হাভেলিতে। তালিকায় এই কেন্দ্রশাসিত এলাকার স্থান ৩২। সেখানকার ওয়াকফ বোর্ড মাত্র ৩০টি সম্পত্তির মালিক। এ ছাড়া চন্ডীগড়ে ৩৪টি, মেঘালয়ে ৫৮টি এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ১৫১টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। তালিকায় এদের স্থান যথাক্রমে ৩১, ৩০ এবং ২৯।

এক সময়ের ফরাসি উপনিবেশ পুদুচেরিতে রয়েছে ৬৯৩টি ওয়াকফ সম্পত্তি। ঝাড়খণ্ডের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ৬৯৮টি সম্পত্তির মালিক। কেন্দ্রশাসিত লক্ষদ্বীপে আছে ৮৯৬টি ওয়াকফ সম্পত্তি। আর দিল্লির ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ১,০৪৭। তালিকায় রাজধানীর স্থান ২৩। বিহারের শিয়া বোর্ডের কাছে আবার আছে ১,৭৫০টি সম্পত্তি, যা দিল্লির চেয়ে কিছুটা বেশি।

মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয় এবং দাতব্য উদ্দেশ্যে দান করা বা নিবেদিত সম্পত্তির দেখভাল করে থাকে ওয়াকফ বোর্ড। এর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, দরগা, সমাধিস্থল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারি তথ্য বলছে, রেল এবং প্রতিরক্ষা দফতরের পর দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ জমির মালিক ওয়াকফ বোর্ড।

ব্রিটিশশাসিত ভারতে ১৯১৩ সালে প্রথম ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। সেখানে পারিবারিক সম্পত্তিকে দাতব্য হিসাবে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ১৯২৩ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আইনে স্বচ্ছতা আনতে বেশ কিছু পরিবর্তন করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ফলে ওয়াকফ আইনি বৈধতা পেয়েছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৫৪ সালের ওয়াকফ আইনে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়টি অবশ্য ১৯৬৪ সালের আগে তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

১৯৯৫ সালে ফের ওয়াকফ আইনের রদবদল করে কেন্দ্র। এতে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা পায় ওয়াকফ ট্রাইবুনাল। ২০১৩ সালের ওয়াকফ সংশোধনী আইনে তৎকালীন কংগ্রেসশাসিত ইউপিএ সরকার এক জন মুসলিম আইনজ্ঞ এবং দুই মহিলা সদস্য-সহ তিন জনের ট্রাইবুনাল গঠন বাধ্যতামূলক করে। পাশাপাশি, ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি বা উপহার দেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়। ওয়াকফ সম্পত্তির ইজারার মেয়াদ ওই আইনে ৩০ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছিল।

কেন্দ্রের বিজেপিশাসিত এনডিএ সরকারের যুক্তি, ওয়াকফ প্রশাসনের আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে বর্তমান আইনটি তৈরি হয়েছে। এতে ওয়াকফের জমি নিয়ে আইনি জটিলতা কেটে যাবে। এর ফলে বিলুপ্ত হবে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র ক্ষমতা। তখন কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পাবেন জেলাশাসক বা সম পদমর্যাদার আধিকারিক।

পাশাপাশি, নতুন আইনে ওয়াকফ বোর্ডে দু’জন অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রীয় পোর্টালে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি এবং জমি নথিভুক্ত করতে হবে। আইনটির বিরোধীদের দাবি, ওয়াকফ বোর্ডের বিভিন্ন সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই ওই বিল এনেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের এনডিএ সরকার।

জামাত-এ-ইসলামি হিন্দ এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো প্রধান মুসলিম সংগঠনগুলির মতে, পদ্মশিবির দীর্ঘ সময় ধরেই দিল্লি-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সেই কারণেই তড়িঘড়ি আনা হল এই আইন। যদিও কেন্দ্রের যুক্তি, খোদ মুসলিম সমাজের গরিব এবং মহিলারাই নাকি এত দিন ওয়াকফ আইন সংস্কারের দাবি জানাচ্ছিলেন।

সংসদে সংশোধিত ওয়াকফ বিলের বিতর্কে যোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট বোর্ডটির হাতে কত পরিমাণ জমি রয়েছে, তার খতিয়ান দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর দাবি, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ওয়াকফের সম্পত্তি ছিল মাত্র দু’টি গ্রাম। বর্তমানে সেটা বাড়তে বাড়তে ৩৯ লক্ষ একরে গিয়ে পৌঁছেছে।

কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের দাবি, গত ১২ বছরে ওয়াকফ বোর্ডের জমির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে লোকসভায় শাহ বলেন, ‘‘১৯১৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বোর্ডটির হাতে মোট ১৮ লক্ষ একর জমি ছিল। এর পর ওয়াকফ আইন সংশোধন করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার।’’

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, ২০১৩ সালে ওয়াকফ আইন সংশোধন করার পর বোর্ডটির ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত ২১ লক্ষ একর জমি সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে ওয়াকফ বোর্ড। একে আইনের ‘অপব্যবহার’ এবং ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ বলে উল্লেখ করেন মোদী মন্ত্রিসভার ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ অমিত শাহ।

ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে দাবি করা বেশ কিছু জমি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেই তালিকায় আছে তামিলনাড়ুর ১,৫০০ বছরের পুরনো চোল মন্দির, ৬০০ জনের বেশি খ্রিস্টান পরিবার বাস করা কেরলের একটি গ্রাম এবং কর্নাটকের একটি বিলাসবহুল হোটেল। এ ছাড়া সংসদ ভবন এবং ইডেন গার্ডেন্সকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে দাবি করার অভিযোগও রয়েছে সংশ্লিষ্ট বোর্ডের বিরুদ্ধে।

গত বছরের ৮ অগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। দীর্ঘ বিতর্কের শেষে ঐকমত্যের লক্ষ্যে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটির (জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি বা জেপিসি) কাছে পাঠায় সরকার। গত ৩০ ডিসেম্বর ১৪টি সংশোধনী-সহ বিলটি সংসদে পেশ করার জন্য সুপারিশ করে জেপিসি।

যৌথ সংসদীয় কমিটিতে সরকারপক্ষের তরফে ২৩ এবং বিরোধীদের তরফে ৪৪টি সংশোধনী প্রস্তাব জমা পড়েছিল। বিরোধীদের সব ক’টি প্রস্তাবই খারিজ করে দেয় জেপিসি। এ বছরের ২ এপ্রিল গভীর রাতে লোকসভায় পাশ হয় সংশোধিত ওয়াকফ বিল। এর পক্ষে ২৮৮ এবং বিপক্ষে ২৩২ জন সাংসদ ভোট দেন।

ঠিক তার পরের দিন (পড়ুন ৩ এপ্রিল) রাজ্যসভায় বিলটি তোলে সরকারপক্ষ। সেখানে লম্বা সময় ধরে বিতর্ক চলার পর ভোটাভুটি চায় বিরোধীরা। বিলের পক্ষে ১২৮টি ভোট পড়ে। আর বিপক্ষে পড়ে ৯৫টি ভোট। অর্থাৎ, ৩৩ ভোটের ব্যবধানে রাজ্যসভায় পাশ হয় ওয়াকফ বিল। নিয়মমাফিক এর পর তা পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে। তিনি সই করায় আইনে পরিণত হয়েছে এই বিল।
সব ছবি: সংগৃহীত।