
জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত কাশ্মীরের পহেলগাঁও। মঙ্গলবার দুপুরে কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার ওই পর্যটনকেন্দ্রের বৈসরন উপত্যকায় জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটে। সেনাকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, বৈসরন উপত্যকায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের একটি দলকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। পর্যটকদের উপর গুলি চালায় অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা।

এখনও পর্যন্ত সেই ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পর্যটক। হামলায় কেউ স্বামীকে হারিয়েছেন, কেউ পুত্রকে! মাত্র কয়েক মিনিটের তাণ্ডবের নেপথ্যে ছিল চার থেকে ছ’জন জঙ্গি। স্থানীয় সূত্রে খবর, জঙ্গিদের পরনে ছিল পুলিশের পোশাক। কেউ কেউ আবার সেনার পোশাক পরেও এসেছিল। সকলের হাতে ছিল একে-৪৭। এই ঘটনায় দেশ জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে তদন্ত।

মঙ্গলবারের নৃশংস জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। কারা এই টিআরএফ?

টিআরএফের উত্থান ২০১৯ সালে। তখন সবে সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’র অবলুপ্তি হয়েছে। ঠিক সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেই পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ‘ছায়া সংগঠন’ হিসাবে উঠে আসে টিআরএফ।

‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ তৈরিতে অনুঘটক হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ নিরাপত্তা পরিষদের ‘১২৬৭ আল-কায়দা নিষেধাজ্ঞা কমিটি’র সিদ্ধান্ত। ওসামা বিন লাদেনের সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগে পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বা ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসাবে ঘোষিত হওয়ার পর জন্ম টিআরএফের।

মুম্বইয়ে ২৬/১১ সন্ত্রাসের চক্রী হাফিজ মহম্মদ সইদ, জাকিউর রহমান লকভিরা ‘দ্য ফিনানশিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’ (এফএএফটি)-র নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ‘ছায়া সংগঠন’ গড়ে কাশ্মীরে নাশকতার ধারা বজায় রাখতে সক্রিয় হয়েছিলেন সেই সময়।

আর সেই সূত্রেই গড়ে উঠেছিল ‘তেহরিক লবাইক ইয়া মুসলিম’ (টিএলএম), ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)-এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠী।

টিআরএফের মূল লক্ষ্য ছিল, কাশ্মীরের স্থিতাবস্থায় বিঘ্ন ঘটানো এবং ভারতের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা। সেই লক্ষ্যসাধনের জন্য নাশকতামূলক কাজকর্মে পুনর্বিন্যাস আনার চেষ্টা শুরু করে এই জঙ্গিগোষ্ঠী। বিশেষ ভাবে নিশানা করা হয় পরিযায়ী শ্রমিক এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের।

গোড়ায় টিআরএফের উপস্থিতি ছিল শুধুই অনলাইনে। পরে ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করে তারা। প্রতিষ্ঠার মাস ছয়েকের মধ্যেই অনলাইন থেকে বাস্তবে রূপ পায় টিআরএফ। জঙ্গি সংগঠন হিসাবে ডানা মেলতে শুরু করে।

নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে লশকর, জৈশ-ই-মহম্মদ-সহ একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের নিযুক্ত করে টিআরএফ। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, টিআরএফ জঙ্গিগোষ্ঠীর দ্রুত বিস্তারের নেপথ্যে সরাসরি ভূমিকা ছিল পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের। ২০২৩ সালে টিআরএফকে ‘সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল কেন্দ্র। জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা।

টিআরএফের জন্ম হয়েছিল কাশ্মীরি জঙ্গি শেখ সাজ্জাদ গুলের হাত ধরে। নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরির আগে গুল ছিলেন লশকরের কমান্ডার। এই সংগঠন তৈরির আগেও সাংবাদিক হত্যা-সহ একাধিক হিংসায় যুক্ত থাকার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

লশকর, জৈশের পাশাপাশি মূলত কাশ্মীরিদের নিয়ে গঠিত জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল মুজাহিদিনের দলছুট গোষ্ঠীর কমান্ডার মাইসের আহমেদ দারও পরবর্তী কালে শামিল হয়েছিলেন টিআরএফে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু তত দিনে টিআরএফের জাল ছড়িয়ে পড়েছিল উপত্যকার গভীরে। গত জুন মাসে জম্মু-কাশ্মীরের রেইসি জেলায় পুণ্যার্থীদের একটি বাসে হামলা হয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ১০ জন পুণ্যার্থীর। ওই হামলার নেপথ্যেও ছিল টিআরএফ।

তবে সূত্র মারফত খবর, বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীরে লশকর এবং টিআরএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে মূলমাথা সইফুল্লা খলিদ। পহেলগাঁও হামলার পরিকল্পনার নেপথ্যেও নাকি তাঁরই হাত রয়েছে।

সইফুল্লা বর্তমানে লশকরের উপপ্রধান বা ডেপুটি চিফ। তিনি পরিচিত সইফুল্লা কসুরি নামেও। ভারতের অন্যতম শত্রু হাফিজ সইদের ঘনিষ্ঠ হিসাবেও পরিচিত।

ভারতে অনেক সন্ত্রাসী হামলার চক্রী হিসাবে সইফুল্লার নাম উঠে এসেছে। বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্যও নাম রয়েছে সইফুল্লার। সব সময়ই নাকি বিলাসবহুল গাড়িতে যাতায়াতের অভ্যাস রয়েছে তাঁর।

সইফুল্লার নিরাপত্তার জন্য সর্বদা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকে লশকর জঙ্গিরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানেও তাঁর বিস্তর প্রভাব। সে দেশের অনেক সেনাকর্তারও নাকি কাছের লোক হিসাবে পরিচিত সইফুল্লা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ‘অনুপ্রেরণা’ জোগাতেও নাকি তাঁকে কাজে লাগানো হয়।

সূত্রের খবর, পহেলগাঁওয়ে হামলার দু’মাস আগে, সইফুল্লা খলিদ পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের কঙ্গনপুরে পৌঁছেছিলেন। কঙ্গনপুরে পাক সেনাবাহিনীর এক বিশাল ব্যাটালিয়ন সব সময় উপস্থিত থাকে। সেখানেই নাকি বক্তৃতা করার জন্য সইফুল্লাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল জ়াহিদ জ়ারিন খট্টক। সেখানে পৌঁছোনোর পর কর্নেল নিজেই তাঁর উপর ফুলবর্ষণ করেছিলেন বলেও শোনা যায়।

সূত্রের খবর, পাক সেনার সামনে দেওয়া সেই বক্তৃতায় নাকি ভারতীয় সেনাকে হত্যার নিদান দিয়েছিলেন তিনি। একই ভাবে, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায় অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিলেন বলেও খবর।

তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ২০২৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাশ্মীর দখল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমরা। আগামী দিনে আমাদের মুজাহিদরা আরও ভয়ঙ্কর হামলা চালাবে। আমরা আশা করি ২০২৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাশ্মীর স্বাধীন হবে।’’

খাইবার পাখতুনখোয়ার সেই সভা আইএসআই এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী যৌথ ভাবে আয়োজন করেছিল বলেও সূত্রের খবর। সংবাদমাধ্যম ‘আজ তক’-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর অ্যাবোটাবাদের জঙ্গলে আয়োজিত একটি জঙ্গি শিবিরে শত শত পাকিস্তানি যুবক অংশগ্রহণ করেছিলেন। লশকরের রাজনৈতিক শাখা পিএমএমএল এবং এসএমএল দ্বারা সংগঠিত সেই সভায় নাকি সইফুল্লাও উপস্থিত ছিলেন।

সূত্রের খবর, সেই শিবির থেকেই নাকি সন্ত্রাসী হামলার জন্য সদস্যদের নির্বাচন করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে তাঁদের ‘টার্গেট কিলিং’-এর প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। পাক যুবাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাঁদের নাকি ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছিল। পুরো প্রক্রিয়ায় সইফুল্লা ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত ছিলেন বলেও গোয়েন্দা সূত্রে খবর।
ছবি: পিটিআই, সংগৃহীত এবং ফাইল।