
ফের সন্ত্রাসে রক্তাক্ত কাশ্মীর। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের মৃত্যু। নিহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার রয়েছে আশঙ্কা। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে পাকিস্তান মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনের হাত রয়েছে, তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। প্রতিশোধ নিতে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে ঢুকে আবার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালাক ভারতীয় ফৌজ, এ হেন দাবিতে সরগরম সমাজমাধ্যম।

বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর মতো সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষে বেশ কঠিন। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রত্যাঘাতের রাস্তা বেছে নিতে পারে ইসলামাবাদ। তখন পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা থাকবে না। আণবিক অস্ত্রের নিরিখে অবশ্য পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি।

উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরে ভারত-পাক পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট’ নামে বিজ্ঞানীদের সংগঠন। সেখানেই দুই দেশের আণবিক অস্ত্রভান্ডারের একটি ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে তারা। মার্কিন গবেষকদের দাবি, এ ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে ভারতীয় ফৌজ।

‘ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে নয়াদিল্লির পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ১৮০। সেখানে পাক সেনার কাছে আছে ১৭০টি আণবিক অস্ত্র। উল্লেখ্য, বিশ্বের মোট ন’টি দেশের কাছে এই গণবিধ্বংসী হাতিয়ার রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া বাকি দেশগুলি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চিন, উত্তর কোরিয়া এবং ইজ়রায়েল।

‘বিশ্বের পরমাণু শক্তির রাষ্ট্র’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে মার্কিন বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এক বছর আগেও ভারতের মোট পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা ছিল ১৭৪। এর পর আরও ছ’টি আণবিক ওয়ারহেড বৃদ্ধি করে নয়াদিল্লি। পাকিস্তান সেটা করতে পারেনি।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের কয়েকটি দেশের কাছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম (হাইলি এনরিচ্ড ইউরেনিয়াম) আছে। ভারত তার মধ্যে অন্যতম। উল্লেখ্য, পরমাণু হাতিয়ার এবং পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ, দু’টি তৈরি করার ক্ষেত্রেই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের একান্ত ভাবে প্রয়োজন হয়।

ইউরেনিয়াম বাদ দিলে প্লুটোনিয়ামের সাহায্যেও পরমাণু বোমা তৈরি করা যায়। মার্কিন বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অস্ত্র নির্মাণের জন্য সমৃদ্ধ প্লুটোনিয়াম বহুল পরিমাণে উৎপাদন করছে নয়াদিল্লি। ২০২৩ সালে একটি আন্তর্জাতিক প্যানেলের জারি করা তথ্য অনুযায়ী, পরমাণু বোমা তৈরির জন্য ভারতের কাছে প্রায় ৬৮০ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম রয়েছে। এর সাহায্যে ১৩০ থেকে ২১০টি আণবিক বোমা নির্মাণ সম্ভব।

উল্লেখ্য, জল-স্থল-আকাশ এবং সমুদ্রের গভীর থেকে পরমাণু হামলা চালাতে সক্ষম ভারত। ফৌজি পরিভাষায় একে বলে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’। এই ক্ষমতা এখনও অর্জন করতে পারেনি পাকিস্তান। ভারতীয় বায়ুসেনার কাছে রয়েছে ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান। এটি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম।

এ ছাড়া পরমাণু হামলা চালানোর জন্য অগ্নি সিরিজ়ের দূরপাল্লার একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ভারতীয় সেনার অস্ত্রাগারে। আছে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। এটিও আণবিক ওয়ারহেড নিয়ে উড়ে গিয়ে হামলা করতে সক্ষম।

সেনার পাশাপাশি ভারতীয় বায়ুসেনা এবং নৌসেনাও ব্রহ্মস ব্যবহার করে। নৌবাহিনীর কাছ রয়েছে কে-১৫ সাগরিকা নামের একটি ক্ষেপণাস্ত্র। এর পাল্লা ৩,৫০০ কিলোমিটার। এটি মূলত ডুবোজাহাজে ব্যবহার হয়। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির সাহায্যে অনায়াসেই করা যাবে পরমাণু হামলা।

উদ্বেগের বিষয় হল, পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি এই ভয়ঙ্কর গণবিধ্বংসী হাতিয়ার হ্রাস করার বদলে বাড়িয়েই চলেছে। পাশাপাশি চলছে আণবিক অস্ত্রাগার আধুনিকীকরণের কাজ। মার্কিন গবেষকদের দাবি, বর্তমানে বিশ্বে মোট পরমাণু ওয়ারহেডের সংখ্যা ১২ হাজার ৩৩১। এর মধ্যে ৯,৬০৪টি ক্ষেপণাস্ত্র, যা স্থল, বিমান এবং নৌবাহিনী ব্যবহার করতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের হাতে রয়েছে ২,১০০টি পরমাণু বোমা। সেগুলিকে অতি সতর্কতায় রাখা হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আক্রমণের জন্য এগুলিকে প্রস্তুত করা যেতে পারে। আণবিক বোমা ফেলার জন্য বোমারু বিমানের প্রয়োজন হয়। সেটি অবশ্য বর্তমানে নেই ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে।

সূত্রের খবর, উত্তর কোরিয়া এবং পাকিস্তান পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য লাগাতার চেষ্টা করে চলেছে। তবে দুনিয়ার মোট আণবিক বোমার ৮৮ শতাংশই রয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছে। গত কয়েক বছরে পরমাণু হাতিয়ার বৃদ্ধি করেনি ফ্রান্স ও ইজ়রায়েল। অন্য দিকে, চিন এর সংখ্যাকে ৬০০-তে নিয়ে গিয়েছে।

কয়েক দিন আগেই একটি অনুষ্ঠানে হিন্দুদের নাম করে বিষোদ্গার করেন পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। ঠিক তার পরই কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হয়েছে এই সন্ত্রাসী হামলা। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর দায় স্বীকার করে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)।

গত বছরের জুন মাসেও জম্মু-কাশ্মীরের রেইসি জেলায় পুণ্যার্থীদের বাসে হামলা চালায় টিআরএফ। তাতে মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ১০ জনের। কুখ্যাত জঙ্গি নেতা শেখ সাজ্জাদ গুলের হাত ধরে লশকরের এই ছায়া সংগঠনটির জন্ম হয় ২০১৯ সালে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ হওয়ার পর।

টিআরএফ জঙ্গিগোষ্ঠীর দ্রুত আড়ে-বহরে বিস্তারের নেপথ্যে সরাসরি ভূমিকা রয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের। ২০২৩ সালে টিআরএফকে ‘সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেন্দ্র।

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় জইশ-ই-মহম্মদের এক জঙ্গি। তাতে প্রাণ হারান ৪০ জন নিরাপত্তাকর্মী। ওই ঘটনার পর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার বালাকোটে জইশ সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পে বিমানহানা চালায় ভারতীয় বায়ুসেনা।

২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের উরি ক্যাম্পে ঢুকে হামলা চালায় চার জইশ জঙ্গি। তাতে প্রাণ হারান ১৯ জন সৈনিক। কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে ভারতীয় সেনা। তাতে সন্ত্রাসীদের একাধিক লঞ্চপ্যাড ধ্বংস করে ফৌজ।

বালাকোট বিমানহানার পর অবশ্য চুপ করে বসে থাকেনি পাকিস্তান। প্রত্যাঘাত শানাতে ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘনের চেষ্টা করে ইসলামাবাদের বায়ুসেনা। কিন্তু তাতে ফল হয় হিতে বিপরীত। তাদের অতি শক্তিশালী এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামান ভারতীয় বায়ুবীরেরা।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার সময় আইএসআইয়ের প্রধান ছিলেন বর্তমান জেনারেল মুনির। জইশের আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনার পিছনে তাঁর হাত ছিল বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ। এ বারও কি তাই? উঠছে সেই প্রশ্ন।
সব ছবি: সংগৃহীত।