আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান নেতার দ্বিতীয় বারের জন্য কুর্সি প্রাপ্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না সে দেশের নারী সমাজের একাংশ। ট্রাম্পের শপথের আগেই পথে নেমেছেন তাঁরা।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ওয়াশিংটনের সাদা বাড়িতে (হোয়াইট হাউস) পা রাখবেন চরম ডানপন্থী রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত ডোনাল্ড। কিন্তু, তার আগেই আমেরিকান প্রমীলাদের ‘ট্রাম্প বিদ্বেষ’কে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
এ বারের প্রেসিডেন্ট ভোটে রিপাবলিকান প্রার্থীর জয় নিশ্চিত হতেই ট্রাম্প-বিরোধী মহিলারা শুরু করেছেন ‘ফোরবি’ আন্দোলন। প্ল্যাকার্ড হাতে তাঁদের একাধিক শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দেখা গিয়েছে। যাতে লেখা, ‘আমার শরীর, আমার পছন্দ’ (মাই বডি, মাই চয়েস)।
আন্দোলনকারী নারী সমাজের অভিযোগ, এ বারের নির্বাচনে ট্রাম্পকে উপচে পড়া সমর্থন জানিয়েছেন পুরুষেরা। যার জেরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজধানীর ‘শ্বেত প্রাসাদ’ দখল করেছেন তিনি।
আর তাই তামাম পুরুষ জাতির উপর ‘প্রতিশোধ’ নিতে ফোরবি আন্দোলনে নেমেছেন ট্রাম্প-বিদ্বেষী আমেরিকান প্রমীলারা। আগামী দিনে প্রেম, বিয়ে, শারীরিক সম্পর্ক বা সন্তানের জন্ম দেওয়া থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিরত থাকবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
ফোরবি আন্দোলনে অংশ নেওয়া বেশ কয়েক জন মহিলা ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন। সেখানে ট্রাম্প জিতে যাওয়ায় তাঁদের হাউহাউ করে কাঁদতে দেখা গিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ডের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা ডেমোক্র্যাটিক নেত্রী কমলা হ্যারিস। প্রচারে ট্রাম্পকে বার বার মহিলা-বিদ্বেষী বলে উল্লেখ করেন তিনি। যা তাঁর পরাজয়ের পর ফোরবি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফোরবি আন্দোলনের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ায়। ফোর, অর্থাৎ চার সংখ্যা থেকে এই কথাটি এসেছে। কোরিয়ান ভাষায় বি শব্দটির অর্থ হল নম্বর। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশটির ধাঁচেই আমেরিকান মহিলারা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
ফোরবি আন্দোলনের প্রভাব গভীর ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজের উপর পড়েছিল। ২০২১ সালে এই ইস্যুতে মুখ খোলেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। সংবাদ সংস্থা ‘সিবিসি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘এই আন্দোলন নারী-পুরুষের সুস্থ সম্পর্কে একটা অন্তরায় তৈরি করেছে।’’
আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার হ্রাসের নেপথ্যে ফোরবি আন্দোলনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের পিএইচডি ছাত্রী মীরা চোই বলেছেন, ‘‘রাষ্ট্র, সরকার এবং পুরুষেরা কী ভাবে দিনের পর দিন শোষণ করে এসেছে, তা নিয়ে এ বার নারী সমাজ ভাবতে শুরু করেছে।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান, আমেরিকার ট্রাম্প-বিদ্বেষী নারী সমাজ হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এলে প্রজননের অধিকার রক্ষা পাবে বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় আন্দোলনের রাস্তা বেছে নেন ওই প্রমীলারা।
অন্য দিকে আমেরিকায় ফোরবি আন্দোলন শুরু হতে না হতেই ইন্টারনেটে এর তথ্যানুসন্ধান হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) আন্দোলনরত এক মহিলা লিখেছেন, ‘‘পুরুষকেন্দ্রিক দুনিয়ায় মহিলাদের কোনও স্থান নেই। আমরা ঐতিহাসিক ভাবে নিপীড়িত। আর তাই আমরা প্রজনন ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করতে চাই। এটা একটা নারীমুক্তির আন্দোলন।’’
আন্দোলনকারীদের দাবি, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁদের কথা শোনা হয়নি। তবে নারী সমাজের সকলেই যে তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন, এমনটা নয়। ট্রাম্প সমর্থক প্রমীলা বাহিনী আবার ফোরবি-পন্থীদের সমালোচনা করেছেন।
এই ইস্যুতে সমাজমাধ্যমে ফোরবি আন্দোলনকারীদের খোঁচা দিতে ছাড়ছেন না ট্রাম্পের মহিলা সমর্থকেরা। তাঁদেরই এক জন এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘তোমরা পুরুষদের সঙ্গে ঘুমোতে চাও না বলে একটা ছেলেরও ঘুম নষ্ট হচ্ছে, তা কিন্তু নয়।’’
দক্ষিণ কোরিয়ায় একটা সময়ে ‘মিটু’ আন্দোলন প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরবর্তী কালে প্রশান্ত মহাসাগরের উপদ্বীপে জন্ম হয় করসেট আন্দোলনের। যাতে ‘উদ্ভট’ সাজের অধিকার চেয়ে পথে নেমেছিলেন কোরীয় প্রমীলারা।
করসেট আন্দোলনকারীরা চুল কেটে বা মস্তক মুণ্ডন করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দিন তা সমাজে প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়ে ফোরবি আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা। যাতে প্রেম, বিয়ে, যৌনতা এমনকি সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক অধিকারের দাবি তোলা হয়।
সংবাদ সংস্থা ‘ভক্স’ জানিয়েছে, ফোরবি আন্দোলনের চার হাজারের বেশি সমর্থক রয়েছেন। এর মাধ্যমে মহিলারা কোরীয় সমাজের লিঙ্গভিত্তিক কঠোর প্রথাগুলিকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন। যেখানে নারী সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট কিছু সূচক নির্ধারণ করা রয়েছে।
২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক মহিলা চিত্রশিল্পী পুরুষ মডেলের নগ্ন ছবি তোলেন। এর পরই ওই তরুণীকে গ্রেফতার করা হয়। যার জেরে ফোরবি আন্দোলেন রাজধানী সিওল থেকে শুরু করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আমেরিকায় দ্রুত গতিতে ফোরবি আন্দোলন ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, সেখানে মহিলা ও পুরুষের যৌন জীবনে তিক্ততার সম্পর্ক ক্রমাগত বাড়ছে। এ বারের নির্বাচনের প্রচারে এবং বিতর্ক সভায় যা বার বার উঠে এসেছে।
ফোরবি আন্দোলন ‘এলজিবিটিকিউ প্লাস’-এর মতো ভিত মজবুত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। তবে আগামী দিনে গর্ভপাত ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে ট্রাম্পের পক্ষে সহজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।