আত্মপ্রকাশের পরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ার তাবড় সব টেক জায়ান্টের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে চিনা স্টার্ট আপ সংস্থা ‘ডিপসিক’। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ একে চিনের যুগান্তকারী এআই মডেল হিসাবেও উল্লেখ করছেন।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি নতুন ‘ওপেন সোর্স রিজ়নিং মডেল’ বা বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি চালু করেছে ‘ডিপসিক’। নাম ‘ডিপসিক-আর১’। একই ধাঁচের আর একটি বহুল ব্যবহৃত এআই প্রযুক্তি হল ওপেনএআইয়ের ‘চ্যাটজিপিটি’।
তবে ‘ডিপসিক-আর১’ আত্মপ্রকাশের পরেই ‘চ্যাটজিপিটি’, ‘জেমিনি’, ‘ক্লড এআই’-এর মতো তাবড় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাগুলি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ার তাবড় সব টেক জায়ান্টের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে চিনা স্টার্ট আপ সংস্থাটি।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের একচেটিয়া ‘নেতা’ হিসাবে প্রথমেই আসবে আমেরিকার নাম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় রাজত্ব চালানো ওপেনএআই, গুগ্ল, মেটা বা অ্যাথ্রোপিকের মতো বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির জন্মও আমেরিকাতেই। তবে ‘ডিপসিক-আর১’ আসার পর মনে করা হচ্ছে, শীঘ্রই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে আমেরিকার একচেটিয়া আধিপত্যে থাবা বসাতে চলেছে চিন। আর তা মনে করার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণও।
‘ডিপসিক’ আত্মপ্রকাশের পরেই আমেরিকা তথা বিশ্বের প্রথম সারির এআই চিপ প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘এনভিডিয়া’র শেয়ার হু হু করে পড়ে গিয়েছে। এক দিনে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি ডলার, ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে যা প্রায় ৫০ লক্ষ কোটি টাকা।
বেজিঙের স্টার্টআপের সেই এআই প্ল্যাটফর্ম এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আর তার সঙ্গেই আলোচনায় উঠে এসেছে ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেংয়ের নামও। মাত্র দু’বছর আগে ছোট্ট একটি স্টার্ট আপ হিসাবে পথচলা শুরু করে ডিপসিক। লিয়াং ওয়েনফেং ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও।
ডিপসিকের বয়স মাত্র দুই বছর। ২০২৩ সালে যাত্রা শুরু করেছিল সংস্থাটি। তবে ডিপসিকের সাফল্যের নেপথ্যে শুধু লিয়াঙের হাত বা মাথা নেই, আরও বেশ কয়েক জনের নাম উঠে আসতে শুরু করেছে। তার মধ্যে অন্যতম লুও ফুলি।
কিন্তু ডিপসিকে কী অবদান রয়েছে ২৯ বছর বয়সি গবেষকের? ‘ডিপসিক-আর১’-এর অন্যতম ‘ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং’ (এনএলপি)। আর সেই এনএলপিতেই দক্ষতা অর্জন করেছেন ফুলি।
বিভিন্ন চিনা সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যেই ফুলিকে কৃত্রিম মেধার ‘বিস্ময় বালিকা’র তকমা দিয়েছে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর এনএলপি-র সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সম্মেলন ‘এসিএল’-এ এক বছরে আটটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ফুলির।
এর পরেই চিনা তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে ফুলির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ‘আলিবাবা’ এবং ‘শাওমি’র মতো শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি ‘জায়ান্ট’দের সঙ্গে কাজ করার সুযোগও পান।
আলিবাবার ‘ড্যামো অ্যাকাডেমি’তে ফুলির অন্যতম অবদান হল ‘ভেকো’— একটি বহুভাষিক প্রাক-প্রশিক্ষণ মডেল তৈরিতে সহযোগিতা করা। ‘এলিসমাইন্ড’ নামে ‘ওপেন সোর্স’ প্রকল্পেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
ফুলির উদ্ভাবনগুলি দ্রুত চিনের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাঁকে ‘ডিপসিক’-এ কাজ করার প্রস্তাব দেন লিয়াং। ২০২২ সালে লিয়াংয়ের সঙ্গে হাত মেলান ফুলি। তবে তখনও ‘ডিপসিক’ আত্মপ্রকাশ করেনি।
ফুলির দক্ষতা ‘ডিপসিক-ভি২’ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এটি এমন একটি মডেল যা এআই বাজারে একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হয়ে ওঠে। ডিপসিকের সাফল্যে ফুলির উল্লেখযোগ্য অবদান ‘শাওমি’র প্রতিষ্ঠাতা লেই জুনের নজর কাড়ে।
সংবাদমাধ্যম ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ফুলির অসামান্য কাজের জন্য তাঁকে বার্ষিক ১ কোটি ইউয়ান (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২ কোটি টাকা) বেতনে কাজের প্রস্তাব দিয়েছেন জুন।
উল্লেখ্য, বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি বাজারে হইচই ফেলেছে ‘ডিপসিক’। কেউ কেউ একে ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। কেন? প্রযুক্তিবিদেরা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বহুল ব্যবহৃত ওপেনএআইয়ের কৃত্রিম মেধা ‘চ্যাটজিপিটি’র কথা বলেছেন। তাঁদের দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিটি তৈরি করতে আমেরিকার টেক জায়ান্ট সংস্থাটির যত খরচ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম টাকায় ‘ডিপসিক-আর১’ বানিয়েছে চিনা স্টার্ট আপ। আর তাই এআইয়ের প্রতিযোগিতার বাজারে এটি অচিরেই ওয়াশিংটনকে পিছনে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এত দিন পর্যন্ত চিনা কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি সংস্থাগুলি অত্যাধুনিক হার্ডঅয়্যারের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম বার সফ্টঅয়্যার নিয়ে কাজ করছে ডিপসিক। আর সেটাই ওয়াশিংটনের সিলিকন ভ্যালির কর্তাব্যক্তিদের যথেষ্ট অবাক করেছে। ‘ডিপসিক-আর১’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা মিলবে বলেও মনে করছেন তাঁরা। ফলে চিনা স্টার্ট আপটির এআই ঘিরে যে আগ্রহ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
ইতিমধ্যেই চিনা স্টার্ট আপ সংস্থাটি এআইয়ের বাজার ধরতে বেশ কিছু লোভনীয় অফার ঘোষণা করেছে। ‘ডিপসিক-আর১’-এর প্রতি ১০ লক্ষ টোকেনের জন্য ২.২ ডলার নেবে তারা। ভারতীয় মুদ্রায় খরচ হবে মাত্র ১৯০ টাকা। এ ব্যাপারে আরও আগ্রাসী ভাবে প্রচার চালাচ্ছে ‘টিকটক’ প্রস্তুতকারী সংস্থা বাইটডান্স।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে বিশ্বের দুই মহাশক্তিধরের মধ্যে ‘কৃত্রিম মেধার যুদ্ধ’ বেধে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে প্রথম ধাপে এগিয়ে গেল চিন। উন্নত এআই প্রযুক্তি তৈরির জন্য প্রতি বছর কয়েক কোটি ডলার খরচ করে আমেরিকা। সেখান থেকে সরে এসে কম খরচে কত দ্রুত নতুন প্রযুক্তি সেখানকার তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি নিয়ে আসতে পারে, সেটাই এখন দেখার।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে চিনকে অতি উন্নত এনভিডিয়া এআই চিপ রফতানি করা বন্ধ রেখেছে আমেরিকা। কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তিকে বিকশিত করতে এই ধরনের চিপগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিপসিকের সাফল্যে এটা প্রমাণিত যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ড্রাগনের উপর সে ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং ওয়াশিংটনকেই খোলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সক্ষম হয়েছে বেজিং।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার জেরে পশ্চিমের টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার বাজারে নামতে চিনা প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছিল। এখান থেকে নিজেদের বার করে আনতে ডাউনস্ট্রিম অ্যাপ্লিকেশনের দিকে ঝুঁকেছে বেজিং। আর তাতেই বড় সাফল্য এসেছে বলে জানিয়েছে তারা।
নতুন এআই প্রযুক্তি বাজারে এনে রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া ডিপসিকের বাজেটেও রয়েছে চমক। এর আগে ‘ডিপসিক-ভি৩’ নামের কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরি করতে মাত্র ৫৬ লক্ষ ডলার খরচ করেছে ওই চিনা স্টার্ট আপ। অন্য দিকে স্যাম অল্টম্যানের নেতৃত্বাধীন ওপেনএআই তাদের ‘জিপিটি-৪’ মডেলের জন্য এখনও পর্যন্ত ব্যয় করেছে প্রায় ১০ কোটি ডলার।
‘ডিপসিক-ভি৩’ কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরি করতে জিপিইউ ব্যবহার করতে হয়েছে চিনা স্টার্ট সংস্থাটিকে। আমেরিকায় এটি সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি হিসাবে বিবেচিত। আগামী দিনে ডিপসিকের এআই ‘জিপিটি-৪’ এবং মেটার তৈরি ‘লামা’ প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ড্রাগনভূমির হ্যাংঝো প্রদেশে রয়েছে ডিপসিকের প্রধান কার্যালয়। সংস্থাটির সিইও লিয়ান ‘কোয়ান্টিটিভ হেজ ফান্ড হাই-ফ্লায়ার’ সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতাও বটে। ২০২১ সালে কয়েক হাজার এনভিডিয়া জিপিইউ কেনেন তিনি। তখন অনেকেই বিষয়টি নিয়ে মজা করেছিলেন। পরে সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে নতুন কৃত্রিম মেধা তৈরি করেন লিয়ান।
সব ছবি: সংগৃহীত।