সৈন্যশক্তির নিরিখে বিশ্বে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে ভারত। অন্য দিকে অবনমন হয়েছে পাকিস্তানের। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’ সেই তালিকা প্রকাশ করতেই চিরশত্রু দুই প্রতিবেশীর ফৌজি ক্ষমতার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। সমীক্ষক সংস্থার দাবি, এ ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি।
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, সৈন্যশক্তির নিরিখে বিশ্বে ভারতের স্থান চার। সেখানে ১২ নম্বর জায়গা পেয়েছে পাকিস্তান। শূন্যকে সূচক ধরে দেওয়া পয়েন্টের নিরিখে এই তালিকা তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থা। অর্থাৎ যে দেশের প্রাপ্ত নম্বর শূন্যের যত কাছে, র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে তাকে তত উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে।
এই নিয়মে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’-এর সমীক্ষকেরা ভারতকে দিয়েছেন ০.১১৮৪ পয়েন্ট। আর পাকিস্তানের প্রাপ্ত নম্বর ০.২৫১৩। তালিকায় প্রথম তিনটি স্থানে রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিন। এই তিন মহাশক্তি পেয়েছে যথাক্রমে ০.০৭৪৪ এবং ০.০৭৮৮ পয়েন্ট। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে থাকা মস্কো ও বেজিঙের প্রাপ্ত নম্বর সমান।
মোট ৬০টি আলাদা আলাদা বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে এই তালিকা তৈরি করে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’। এর মধ্যে অন্যতম হল সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক বাজেট। এ ছাড়া কোন দেশের কাছে কী কী অত্যাধুনিক হাতিয়ার রয়েছে, তালিকা তৈরির সময়ে সেটিও খতিয়ে দেখে তারা। এ বার মোট ১৪৫টি দেশকে র্যাঙ্কিং দিয়েছে এই আন্তর্জাতিক ফৌজি সমীক্ষক সংস্থা।
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’-এর দাবি, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা খাতে ৭,৫০০ কোটি ডলার খরচ করেছে নয়াদিল্লি। অন্য দিকে পাক সরকারের ব্যয়বরাদ্দ ছিল ৭৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাজেটের নিরিখে ইসলামাবাদের চেয়ে ৬,৭৩৬ কোটি ডলার বেশি খরচ করেছে নয়াদিল্লি।
লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আর্থিক দুরবস্থা। বর্তমানে ইসলামাবাদের মাথায় ঝুলছে ৯,২৪২ কোটি ডলারের ঋণ। পশ্চিমের প্রতিবেশীর বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারও অনেকটাই ফুরিয়ে এসেছে। পাক সরকারের কোষাগারে রয়েছে ১,৩৭৩ কোটি ডলারের বিদেশি মুদ্রা। অন্য দিকে ভারতের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে থাকা বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ প্রায় ৬৩ হাজার কোটি ডলার বলে জানিয়েছে সমীক্ষক সংস্থা।
বিদেশি মুদ্রার নিরিখে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভারত। এই দিক থেকে পাকিস্তানের স্থান ৭১। ইসলামাবাদের দেউলিয়া হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে বলে কিছু দিন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক। যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ কেনার দিক থেকে নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদের ফারাক চোখে পড়ার মতো। এ ক্ষেত্রে দু’টি দেশ পেয়েছে যথাক্রমে তিন এবং ২৫ র্যাঙ্কিং।
ভারতের স্থলসেনা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। সেখানে অ্যাক্টিভ এবং রিজ়ার্ভ দুই ধরনের সৈনিক রয়েছেন। তাঁদের সংখ্যা যথাক্রমে ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫৫০ এবং ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার। পাক ফৌজের অ্যাক্টিভ সৈনিকের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার। এ ছাড়া রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের কাছে রয়েছে সাড়ে পাঁচ লক্ষের একটি রিজ়ার্ভ বাহিনী। এই সংখ্যার নিরিখে ইসলামাবাদ রয়েছে সাত নম্বরে।
আধা সেনার সংখ্যার দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের র্যাঙ্কিং যথাক্রমে দুই ও ছয়। ২৫.২৭ লক্ষের আধা সেনাবাহিনী রয়েছে নয়াদিল্লির। পাকিস্তানের আধা সেনার সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। সেনাবাহিনীর কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন দুই দেশের আধা সৈনিকরা। ভারতের আধা সেনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন।
ভারতীয় স্থলবাহিনীর হাতে রয়েছে ৪,২০১টি ট্যাঙ্ক এবং ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৯৪টি সাঁজোয়া গাড়ি। চাকা লাগানো কামানের (সেল্ফ প্রপেলড হাউইৎজ়ার) সংখ্যা ১০০। এ ছাড়া ৩,৯৭৫টি অন্য ধরনের কামানও ব্যবহার করে এ দেশের সেনাবাহিনী। অন্য দিকে পাক ফৌজের ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি এবং কামানের সংখ্যা যথাক্রমে ২ হাজার ৬২৭, ১৭ হাজার ৫১৬ ও ২ হাজার ৬২৯।
চাকা লাগানো কামান অবশ্য ভারতের চেয়ে বেশি রয়েছে ইসলামাবাদের। সেটির সংখ্যা ৬৬২। নয়াদিল্লির গোলন্দাজ বাহিনী আবার পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে। বর্তমানে এর পাল্লা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। মধ্য এশিয়ার দেশ ভারতের থেকে এই হাতিয়ারটি আমদানি করেছে। পিনাকা কেনার ব্যাপার আগ্রহ দেখিয়েছে ফ্রান্সও।
পাক সেনা যে রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে তার নাম ফতেহ। এর পাল্লা ও শক্তি পিনাকার নিরিখে অনেকটাই কম। ভারতীয় হাতিয়ারটি থেকে একসঙ্গে ছ’টি রকেট ছোড়া সম্ভব। অন্য দিকে ইসলামাবাদের রকেট লঞ্চারে রয়েছে মাত্র দু’টি রকেট। তবে সংখ্যার দিক থেকে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা বেশি রকেট লঞ্চার ব্যবহার করেন। তাঁদের কাছে রয়েছে ৬০০টি ফতেহ। আর ভারতীয় সেনা পিনাকা মোতায়েন করেছে ২৬০টি।
ক্ষেপণাস্ত্রের দিক থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে নয়াদিল্লি। ফিলিপিন্সকে ইতিমধ্যেই তা রফতানি করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ব্রহ্মস কেনার প্রতিরক্ষা চুক্তি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
এ ছাড়া একাধিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে ভারতীয় সেনার অস্ত্রাগারে। তার মধ্যে অন্যতম হল অগ্নি-৫। অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে প্রলয়, সূর্য ও পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম। পাক ফৌজ ব্যবহার করে গজ়নভি, আবদালি, শাহিন এবং বাবরের মতো ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলি অধিকাংশই ব্যালেস্টিক শ্রেণির। তবে পাল্লার দিক থেকে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলির থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ইসলামাবাদের দূরপাল্লার অস্ত্র।
বর্তমানে হাইপারসোনিক (শব্দের পাঁচ গুণ বেশি জোরে ছুটতে পারে) ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকে নজর দিয়েছে ডিআরডিও। এতে প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছে ভারত। মহাশূন্যে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহ, অন্তরীক্ষযান বা মহাকাশ স্টেশনকে চোখের নিমেষে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে। পাকিস্তানের কাছে এই ধরনের কোনও হাতিয়ার নেই।
‘গ্লোবার ফায়ারপাওয়ার’ জানিয়েছে, ভারতীয় নৌসেনার রয়েছে মোট ২৯৩টি রণতরী। এর মধ্যে বিমানবাহী যুদ্ধপোতের সংখ্যা দুই। এই ধরনের আরও একটি রণতরী তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। ১৩টি ডেস্ট্রয়ার, ১৪টি ফ্রিগেট এবং ১৮টি করভেট ব্যবহার করেন এ দেশের জলযোদ্ধারা।
ভারতীয় নৌসেনায় মোট ডুবোজাহাজের সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে তিনটি পরমাণু শক্তিচালিত এবং পরমাণু হাতিয়ারে সজ্জিত ডুবোজাহাজ। পাক নৌবাহিনীর হাতে থাকা মোট রণতরীর সংখ্যা ১২১। ইসলামাবাদের কোনও বিমানবাহী রণতরী ও ডেস্ট্রয়ার নেই। মাত্র ৮টি ডুবোজাহাজ এবং ৯টি করে ফ্রিগেট ও করভেট ব্যবহার করে তারা। এর মধ্যে একটি ডুবোজাহাজও পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত নয়।
মোট ৫১৩টি লড়াকু বিমান রয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনায়। পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ৩২৮টি। দু’টি দেশের কাছেই কোনও বোমারু বিমান নেই। নয়াদিল্লির হাতে থাকা মালবাহী বিমানের সংখ্যা ২৭০। অন্য দিকে ইসলামাবাদের কাছে এই ধরনের বিমান রয়েছে ৬৪টি।
তিন বাহিনী মিলিয়ে ভারতীয় ফৌজ মোট ৮৯৯টি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। এর মধ্যে হামলাকারী হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৮০। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ৫৭। ইসলামাবাদের মোট হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৩৭৩।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ব্যবহার শুরু করেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। এ ছাড়া ঘরোয়া প্রযুক্তিতে তৈরি আকাশ নামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে। অন্য দিকে চিনের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে ইসলামাবাদ। কয়েক বছর আগে ভুলবশত একটি ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র পাক মাটিতে আছড়ে পড়ে। সেটিকে চিহ্নিতই করতে পারেনি ওই চিনা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফলে তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
আধুনিক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে ড্রোন। সে দিক থেকে ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে ভারত। ঘরের মাটিতে তৈরি একাধিক আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যান রয়েছে নয়াদিল্লির অস্ত্রাগারে। এ ছাড়া আমেরিকা থেকে এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন কিনেছে মোদী সরকার। পাক সেনা আবার ব্যবহার করে তুরস্কের তৈরি ‘ব্যারেক্টার টিবি-২’ নামের আত্মঘাতী ড্রোন।
সুইডিশ গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোল্ম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের থেকে ভারতের কাছে বেশি সংখ্যায় পরমাণু হাতিয়ার রয়েছে। তাঁদের দাবি, নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের আণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৭২ ও ১৭০। তবে নিউট্রন, ফিশন এবং থার্মোনিউক্লিয়ার— এই তিন ধরনের অস্ত্রই রয়েছে ভারতীয় ফৌজের অস্ত্রাগারে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ১৮০-২০০টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে ভারত।
শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে ভারত। অর্থাৎ, জল, স্থল এবং আকাশ— তিন জায়গা থেকে পরমাণু হামলার ক্ষমতা রয়েছে নয়াদিল্লির। এমনকি সমুদ্রের গভীরে থেকেও আণবিক আক্রমণ চালাতে পারবে ভারতের নৌসেনা। এই ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই।
সব ছবি: সংগৃহীত।