‘অন্ধকার মহাদেশে’ পড়েছে চিনের কুনজর! সুযোগ বুঝে সেখানকার যা কিছু ভাল, সবটাই লুটের পরিকল্পনা রয়েছে বেজিংয়ের। ব্যাপারটা নজরে আসতেই নড়েচড়ে বসেছে ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকা। শুধু তা-ই নয়, দাবার পাল্টা চালে ড্রাগনকে মাত দিতে উঠেপড়ে লেগেছে ওয়াশিংটন। দুই শক্তিধরের এ হেন ‘শঠে শাঠ্যং’ মনোভাবে প্রমাদ গুনছে গোটা বিশ্ব।
দীর্ঘ দিন ধরেই আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চালবাজ চিন। ২০০৯ সালে আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা এই মহাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বেজিং। এই দিক দিয়ে আমেরিকাকে অনেকটা পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে ড্রাগন। তথ্য বলছে, সম্প্রতি আমেরিকা-আফ্রিকা বাণিজ্যের চার গুণ বেশি চিনা সামগ্রীর লেনদেন চলছে সংশ্লিষ্ট মহাদেশে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের দাবি, আফ্রিকায় বেজিংয়ের বাণিজ্যিক প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় গোটা মহাদেশ জুড়ে আমেরিকার প্রভাব কমতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সেখানে পা রাখা কঠিন হবে, এই আশঙ্কায় ঘুম উড়েছে তাঁদের। আর তাই আফ্রিকার ‘চিনা প্রেম’ কমাতে পাল্টা ঘুঁটি সাজাচ্ছে ওয়াশিংটন।
আমেরিকার শীর্ষ পদাধিকারীরা মনে করেন বৈদেশিক বাণিজ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বেজিংয়ের প্রাণভোমরা। ফলে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে আফ্রিকায় ব্যবসা বাড়াতে পারলে ড্রাগনের শরীরে ধরবে ক্ষয়। সেই লক্ষ্যে সাফল্য পেতে ‘লোবিটো করিডর’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র দেশ।
গত বছর (পড়ুন ২০২৩) প্রথম বার এই আর্থিক করিডর প্রকল্পের কথা দুনিয়ার সামনে আনে আমেরিকা। এতে তৈরি হবে ১,৩০০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ। অ্যাঙ্গোলার লোবিটো বন্দর থেকে শুরু হবে রেললাইন পাতার কাজ। মধ্য আফ্রিকার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী কঙ্গো ও দক্ষিণ আফ্রিকার জ়াম্বিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবে সেই রেললাইন।
সিংহ, চিতা, জিরাফ আর মাসাই-সহ অসংখ্য আদিম উপজাতির জন্মভূমিতে অবশ্য ইতিমধ্যেই উন্নয়নের লোভের জাল বিস্তার করেছে চিন। গত এক দশক ধরে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর (বিআরআই) নামে সেখানকার অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে মুঠোবন্দি করছে বেজিং। এখনও পর্যন্ত আফ্রিকার ৫২টি দেশের সঙ্গে বিআরআই সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি করেছে ড্রাগন।
বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে আফ্রিকা জুড়ে রাস্তা, সমুদ্র ও বিমানবন্দর, রেলপথ-সহ অন্যান্য পরিকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজ করছে চিন। এ কথা শুনতে ভাল লাগলেও ব্যাপারটা মোটেই খুব সহজ নয়। প্রথমত, এই প্রকল্পের নামে আফ্রিকার গরিব দেশগুলিকে চড়া সুদে কোটি কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বেজিং। দ্বিতীয়ত, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিআরআই প্রকল্পের কাজ চিনা সংস্থাকেই দিতে হচ্ছে তাঁদের।
ফলে পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে মহাদেশটির ভিতরে যে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, এমনটা নয়। উল্টে যত সময় গড়াচ্ছে ততই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকার দেশগুলি। এ ভাবে চলতে চলতে একটা সময়ে দেউলিয়া পরিস্থিতি তৈরি হলে সেখানকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে ড্রাগন যে দ্বিতীয় বার ভাববে না, তা বলাই বাহুল্য।
পশ্চিমি সংবাদ সংস্থা ‘জিয়ো পলিটিক্যাল মনিটার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত বছর (পড়ুন ২০২৩) বিআরআই প্রকল্পে আফ্রিকার দেশগুলিকে ২,১৭০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চিন। বিনিময়ে আফ্রিকার বিশাল খনিজ সম্পদের দখল নিয়েছে বেজিং। উদাহরণ হিসাবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর কথা বলা যেতে পারে। মধ্য আফ্রিকার দেশটির সমস্ত কোবাল্ট ও তামার খনির ৭২ শতাংশ মালিকানা রয়েছে ড্রাগনের হাতে।
একই কথা গিনির ক্ষেত্রেও সত্যি। সেখানকার বক্সাইট শিল্পে একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে চিনা সংস্থার। এ ছাড়া সিমান্ডু লৌহখনির একটা বড় অংশীদারি পেয়েছে বেজিং। ড্রাগনের এই ঋণ-জালের দড়ি লোবিটো করিডর দিয়ে কেটে ফালা ফালা করা যাবে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) অক্টোবরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে লোবিটো করিডরের নীল নকশা পেশ করে আমেরিকা। এই প্রকল্প আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, আফ্রিকা ফিন্যান্স কর্পোরেশন, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান কমিশনকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিমের জ়াম্বিয়াকে রেলপথের মাধ্যমে আটলান্টিকের তীরের অ্যাঙ্গোলার লোবিটো সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে জুড়ে ফেলার স্বপ্ন দেখছে আমেরিকা। রেলপথ নির্মাণ শেষ হলে লোবিটো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য মধ্য আফ্রিকার দেশগুলিতে অতি সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। আর তখনই আফ্রিকার বাজারে সরাসরি চিনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবে আমেরিকা।
এই প্রকল্পে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে ওয়াশিংটন। এতে বেসরকারি লগ্নিকেও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, পরিবহণ, কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্ন শক্তি (ক্লিন এনার্জি) ও ডিজিটাল পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্যেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করছে আমেরিকা।
আফ্রিকার এই ‘খেলা ঘোরানো’ প্রকল্পের অধিকাংশ টাকাই আসছে ‘পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ (পিজিআই) তহবিল থেকে। ২০২২ সালে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির যৌথ উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করে এই তহবিল। আর্থিক ভাবে দুর্বল দেশে পরিকাঠামো উন্নয়নের অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে তহবিলটিকে আগেও বড় ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছে।
আর্থিক দিক থেকে লোবিটো করিডরকে আরও লাভজনক করতে আমেরিকার আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী দিনে এই প্রকল্পের মাধ্যমে জ়াম্বিয়ার জ়িম্বে সীমান্ত থেকে চিঙ্গোলা পর্যন্ত তৈরি হবে সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার রেলপথ। সারি দেওয়া তামার খনির জন্য ভূতাত্ত্বিকদের কাছে চিঙ্গোলার আলাদা পরিচিতি রয়েছে।
সূত্রের খবর, ভবিষ্যতে জ়িম্বে-চিঙ্গোলা রেলপথ অ্যাঙ্গোলার দিক থেকে তৈরি হওয়া নতুন রেললাইনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। ফলে আটলান্টিকের তীরে পৌঁছনোর রাস্তা পাবে জ়াম্বিয়া। শুধু তা-ই নয়, জালের মতো বিস্তার লাভ করা রেলপথ লাকানোর বেঙ্গুয়েলা রেললাইনের সঙ্গেও জুড়ে যাবে বলে খবর সামনে এসেছে।
আফ্রিকার বেঙ্গুয়েলা রেলপথ ১২০ বছরের পুরনো। লোবিটো করিডর এবং জ়িম্বে-চিঙ্গোলা রেলপথের সঙ্গে তার সংযুক্তি অন্ধকার মহাদেশটির অর্থনীতির সূচককে অন্য স্তরে নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। লোবিটো প্রকল্পে করিডর বরাবর ২৬০ কিলোমিটার লম্বা ফিডার রাস্তা তৈরির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে আমেরিকা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর তামার খনিকে নিশানা করে এই করিডর তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখান থেকে চিনকে উৎখাত করাই এর মূল উদ্দেশ্য। পিজিআইয়ের বিশেষ সমন্বয়কারী হেলাইনা মাতজা জানিয়েছেন, কঙ্গো থেকে আমেরিকায় তামা সরবরাহ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। লোবিটো করিডরের প্রথম পর্যায়ের কাজ মসৃণ ভাবেই চলছে।
এই করিডরকে তানজ়ানিয়া পর্যন্ত প্রসারিত করার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রক। সে ক্ষেত্রে লোবিটোকে ট্রান্স আফ্রিকা করিডরের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ খুলে যাবে ওয়াশিংটনের সামনে। পাশাপাশি, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে একটা সেতু হিসাবে কাজ করবে এই ট্রান্স আফ্রিকা করিডর।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, লোবিটো প্রকল্প ট্রান্স আফ্রিকান করিডরে বদলে গিয়ে আফ্রিকায় শেষ হবে চিনের দাদাগিরি। কূটনৈতিক দিক থেকে এই মহাদেশের উপর আমেরিকার প্রভাব বিস্তার করা অনেক সহজ হবে। ইতিমধ্যেই আফ্রিকায় ৩০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। স্থানীয় আর্থিক উন্নতিতে এই টাকা খরচ হবে বলে জানা গিয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।