এ যেন সুচ দেখে চালুনির বাঁকা মন্তব্য! ঘুষকাণ্ডে সেই হালই হয়েছে আমেরিকার। সেখানকার একগুচ্ছ সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে মোটা টাকা ‘উপঢৌকন’ দিয়ে ভারতের থেকে বরাত হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ। ফলে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে ওয়াশিংটন। যদিও এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’-এর মুখ যে পুড়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি বেশ কিছু ভারতীয় সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তদন্তে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনী। সূত্রের খবর, সেখানেই উঠে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকার নামী-দামি কয়েকটি সংস্থার ঘুষ-কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর এই সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ডেলি পাইওনিয়র’ নামের আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যম। সেখানে বলা হয়েছে, মোটা টাকার কাজের বরাত পেতে ভারতীয় কর্তাদের ঘুষ দেয় তিনটি আমেরিকান সংস্থা। বিষয়টি জানাজানি হতে আইনি মামলায় জড়িয়ে পড়া এড়াতে তিনটি সংস্থা মোটা টাকা জরিমানা দিয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘ডেলি পাইওনিয়র’-এর রিপোর্টে যে তিনটি আমেরিকান সংস্থার কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল, মুগ ইনকর্পোরেটেড, ওরাকল এবং অ্যালবেমার্লে কর্পোরেশন। এই তিন সংস্থার বিরুদ্ধে ভারতীয় রেল, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল), রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন’-সহ একাধিক ভারতীয় সরকারি সংস্থাকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনটি মামলার মধ্যে দু’টিতে ভারতীয় রেলের পদস্থ কর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছে আমেরিকার সংস্থাগুলি। শুধু তাই নয়, বিষয়টি জানাজানি হতে সক্রিয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ‘সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’। তখন জরিমানা বাবদ গড়ে ঘুষের তিন গুণ টাকা জমা করে অভিযুক্ত তিন সংস্থা।
ঘুষকাণ্ডে প্রথমে নাম জড়ায় মুগ ইনকর্পোরেটেডের। হ্যাল এবং ভারতীয় রেলের পদস্থ কর্তাদের পাঁচ কোটি ডলারের বেশি ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থার বিরুদ্ধে। সামরিক সরঞ্জাম, মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত সামগ্রী এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত ছোটবড় নানা আকারের যন্ত্রপাতি নির্মাণে মুগের দুনিয়াজো়ড়া খ্যাতি রয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জামও তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থা।
আমেরিকার গোয়েন্দা নথি উদ্ধৃত করে ‘ডেলি পাইওনিয়র’ জানিয়েছে, ভারতীয় সহায়ক সংস্থা ‘মুগ মোশন কন্ট্রোলস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর (এমএমসিপিএল) রেল এবং হ্যালের শীর্ষ আধিকারিকদের ঘুষ দিয়েছে মুগ। ঘুষের টাকা পেয়েছেন দক্ষিণ-মধ্য রেল এবং ‘রেলওয়ের রিসার্চ ডিজ়াইনস্ অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজ়েশন’-এর (আরডিএসও) কর্তারা।
ঘুষের মাধ্যমে দক্ষিণ-মধ্য রেল থেকে ৩৪ হাজার ৩২৩ ডলার এবং হ্যালের থেকে ১৩ লক্ষ ৯৯ হাজার ৩২৮ ডলারের বরাত হাতিয়ে নিতে চেয়েছে এমএমসিপিএল। হ্যালের শীর্ষ আধিকারিকদের এর জন্য পাঁচ শতাংশ কমিশন দিয়েছে মুগ। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা রিপোর্টেই সেই তথ্য রয়েছে বলে দাবি করেছে ‘পাইওনিয়র’।
কিন্তু ধরা পড়ার পর মুগকে ১৬ লক্ষ ৮০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। অন্য দিকে বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ওরাকলের বিরুদ্ধেও উঠেছে ভারতীয় রেলের কর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ। সেই অঙ্ক ৬৮ লক্ষ ডলার বলে প্রতিবেদনে দাবি করেছে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম।
ভারতীয় রেলের কর্তাব্যক্তি ছাড়াও ওরাকলের বিরুদ্ধে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং তুরস্কের বিভিন্ন সংগঠনকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে সাজা এড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাটিকে ২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার জরিমানা দিতে হবে বলে জানা গিয়েছে। জরিমানার টাকা ওরাকল জমা করেছে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
তৃতীয় অভিযোগটিতে নাম জড়িয়েছে আমেরিকার রাসায়নিক সামগ্রী প্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যালবেমার্লে কর্পোরেশনের। ‘পাইওনিয়র’-এর দাবি, ওই সংস্থার দেওয়া ঘুষের পরিমাণ ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ ডলার। অভিযোগ, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামে কর্মরত ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েলের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এই নামী সংস্থা।
বিশ্বের অন্তত ৭০০টি তেল শোধনাগারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে অ্যালবেমার্লে কর্পোরেশনের। সেখানে বিশেষ একটি রাসায়নিক সামগ্রী সরবরাহ করে এই আমেরিকান সংস্থা। অভিযোগ, ইন্ডিয়ান অয়েলের কর্তাদের ঘুষ দিয়ে ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার শোধনাগারে সেটি সরবরাহের বরাত পেতে চেয়েছে অ্যালবেমার্লে। জরিমানা বাবদ তাদের জমা করা ডলারের পরিমাণ ১৯ কোটি ৮০ লক্ষ।
ঘুষকাণ্ডে অ্যালবেমার্লের নাম জড়ানো নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতের উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের ১১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার ‘উপঢৌকন’ দিয়ে বিভিন্ন বরাত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে আমেরিকার এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এই সময়সীমার মধ্যে ভারতের ব্যবসা থেকে সংস্থার লাভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ কোটি ১১ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার।
চলতি বছরের নভেম্বরে ভারতীয় ধনকুবের শিল্পপতি গৌতম আদানি এবং তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার ঘুষ এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। আমেরিকার একটি আদালতে এই সংক্রান্ত মামলাও রুজু হয়েছে। গৌতম এবং তাঁর সংস্থার পদস্থ কর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভারতের রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ চুক্তির বরাত পেতে ভারতের সরকারি কর্তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁরা।
ঘুষকাণ্ডে নাম জড়িয়েছে গৌতমের ভাইপো সাগর আদানিরও। বাকি ছয় অভিযুক্তের মধ্যে রয়েছেন ‘আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড’-এর সিইও বিনীত জৈন, রঞ্জিত গুপ্ত, রূপেশ আগরওয়াল, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের নাগরিক সিরিল ক্যাবানেস, সৌরভ আগরওয়াল এবং দীপক মলহোত্র।
নিউ ইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের ইউএস অ্যাটর্নি অফিস থেকে জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তিতে ঘুষের অভিযোগে প্রকাশ্যে আসে। আমেরিকার শেয়ার বাজারে বিপুল লগ্নি রয়েছে গৌতম আদানির। সেই কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তদন্তে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ।
আমেরিকার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, আদানি, তাঁর ভাইপো সাগর এবং অন্যেরা বিপুল লাভের আশায় ওই প্রকল্প ‘হাতাতে’ চেয়েছিলেন। সেই জন্যই ২২৩৭ কোটি টাকারও বেশি ঘুষ দিতে রাজি ছিলেন তাঁরা। রঞ্জিত গুপ্ত এবং রূপেশ আগরওয়াল ‘আজ়ুরে পাওয়ার’ নামে সংস্থার সিইও এবং পরামর্শদাতা। আমেরিকার সরকারি আইনজীবীদের দাবি, ‘ইন্ডিয়ান এনার্জি কোম্পানি’ এবং ‘আজ়ুরে পাওয়ার’ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’ (এসইসিআই)-কে ১২ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ করার চুক্তি পেয়েছে।
এই ঘটনায় খোলাখুলি ভাবে আদানির পাশে দাঁড়িয়েছে ইজ়রায়েল। অন্য দিকে যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গুজরাতের ভূমিপুত্র গৌতম। এই বিষয়ে কেন্দ্রকে নিশানা করতে ছাড়েনি কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি। এক মাসের মধ্যেই এ বার প্রকাশ্যে এল খোদ একাধিক আমেরিকান সংস্থার বিরুদ্ধে ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ।
সব ছবি: সংগৃহীত।