বছরের শেষে ঘূর্ণিঝড় ‘চিডো’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড ভারত মহাসাগরের ফ্রান্স-নিয়ন্ত্রিত মায়োট। ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে গোটা দ্বীপপুঞ্জ। গত প্রায় ১০০ বছরে যতগুলি ঘূর্ণিঝড় দ্বীপটিতে আঘাত হেনেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ছিল এই ‘চিডো’। রাস্তায় থাকা বড়-ছোট গাড়ি হোক বা দোকান, সব কিছুকেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে রুদ্রমূর্তি ধারণ করা ঘূর্ণিঝড়।
আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড ও মাদাগাস্কারের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান মায়োটের। এটি ফ্রান্স অধিকৃত কিছু দ্বীপের সমষ্টি। দু’টি প্রধান দ্বীপ নিয়ে গঠিত মায়োটের আয়তন আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির প্রায় দ্বিগুণ।
গত শনিবার মায়োটের বুকে আছড়ে পড়ে সাজানো দ্বীপটিকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে ‘চিডো’। সেই আঘাতে এখনও পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকশো কিংবা হাজারও পেরোতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন মায়োটের প্রশাসক ফ্রাঁসোয়া-জাভিয়ে বিয়ুভিল।
ফ্রান্সের আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুসারে, ‘চিডো’ একটি চতুর্থ পর্যায়ের ঘূর্ণিঝড়। দেশটির আবহবিদেরা জানিয়েছেন, ৯০ বছরের মধ্যে হানা দেওয়া ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিধ্বংসী।
গত দুই দিন ধরে প্রবল বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাস তাণ্ডব চালাচ্ছে মায়োটে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অন্তত ১৪ জন মারা গিয়েছেন ও ২৪৬ জন আহত হয়েছেন। হাসপাতালে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। যদিও মৃত ও আহতদের সঠিক সংখ্যা বার করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘চিডো’ ২২৫ কিলোমিটার বেগে মায়োটের উপর দিয়ে বয়ে যায়। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় অঞ্চলটি। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো দ্বীপ। বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত রকমের যোগাযোগ ব্যবস্থাও। সব কিছু তছনছ হয়ে যায় নিমেষে। ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষের বসবাস ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপটিতে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলেছেন, খাবার, জল ও আশ্রয়ের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সেখানে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ঘরবাড়ি, সরকারি ভবন এবং একটি হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ‘চিডো’র তাণ্ডবে।
মায়োটের বাসিন্দা মহম্মদ ইসমাইল ফোনে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সেখানকার পরিস্থিতি সঙ্গিন হয়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত মায়োটের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পারমাণবিক যুদ্ধে যেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে, ‘চিডো’ হানার পর তেমনটাই পরিস্থিতি। আশপাশের বিভিন্ন জায়গা হঠাৎ করেই যেন চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।’’
আফ্রিকার দক্ষিণে মাদাগাস্কারের কাছে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জে দ্রুত উদ্ধার অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। এলাকায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধারকাজ চালানোর প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ চলছে বলে জানা গিয়েছে। ফরাসি সরকার ওষুধ, জল, খাদ্যসামগ্রী-সহ মায়োটে ত্রাণের দল পাঠিয়েছে।
পুলিশ, দমকলবাহিনী ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরকে একযোগে উদ্ধারকাজে নামিয়েছে সরকার। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী উদ্ধার অভিযানে ২৫০ জন কর্মী পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট।
ফরাসি বিদেশ মন্ত্রকের এক জন আধিকারিক জানিয়েছেন, মায়োটে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। যে হেতু এটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল, তাই মৃতদেহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমাহিত করা হয়। সেই কারণে পরিস্থিত আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই জোরকদমে চলছে উদ্ধারকাজ।
এমনিতেই ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা মায়োট। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, মায়োটে এক লক্ষেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী বাস করেন। তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়।
এই অঞ্চলের বাসিন্দারা ফ্রান্সের আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভর করে দিন গুজরান করেন। দারিদ্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অভিবাসী সমস্যায় জর্জরিত মায়োট।
প্যারিস থেকে প্রায় আট হাজার কিমি দূরে অবস্থিত মায়োট ফ্রান্সের বাকি অংশের তুলনায় আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে অনুন্নত। গত কয়েক দশকে হাজার হাজার মানুষ পূর্ব আফ্রিকার উপকূলের কোমোরোস থেকে মায়োটে যাওয়ার চেষ্টা করছেন একটু উন্নত জীবনযাত্রা লাভের আশায়। কোমোরোসের অবস্থা মায়োটের চেয়েও খারাপ। আর সেখান থেকে মানুষ আসায় মায়োটের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। মায়োটের জনগণের প্রায় ৭৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করেন। এখানে তিন জনের মধ্যে এক জন বেকার।
মায়োটকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করার পরে ঘূর্ণিঝড়টি রবিবার উত্তর মোজ়াম্বিকে আঘাত হানে। সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও সঠিক ভাবে পরিমাপ করা যায়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।