নিঠারিকাণ্ড। ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া হাড়হিম করা ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম। এই কাণ্ডে শারীরিক নির্যাতন, খুন, নরমাংস ভক্ষণ এবং শবদেহের সঙ্গে সঙ্গমের মতো একাধিক জঘন্য অপরাধের অভিযোগ ছিল। অপরাধের নৃশংসতা এবং বিরল প্রকৃতির কারণে মামলাটি বহু দিন ছিল সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে।
নয়ডার নিঠারিকাণ্ডের সেই দুই মূল অভিযুক্ত মণীন্দ্র সিংহ পান্ধের এবং সুরেন্দ্র কোহলির ফাঁসির সাজা সোমবার রদ করল ইলাহাবাদ হাই কোর্ট। নিম্ন আদালতে ফাঁসির সাজা হয়েছিল দুই অভিযুক্তের। আদালত সূত্রে খবর, সুরেন্দ্রকে ১২টি মামলায় এবং মণীন্দ্রকে দু’টি মামলায় বেকসুর ঘোষণা করেছে উচ্চ আদালত। তাতেই তাঁদের ফাঁসির সাজা রদ হল।
নিঠারিকাণ্ডের তদন্ত চলাকালীন ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নিঠারির ব্যবসায়ী পান্ধেরের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ১৯টি কঙ্কাল এবং কিছু দেহাবশেষ। এই ঘটনায় গোটা দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার নৃশংসতা নিয়ে লেখালিখি শুরু হয় সংবাদমাধ্যমে।
তদন্ত চলাকালীন অভিযোগ ওঠে যে, শিশু, কিশোর-কিশোরীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে খুন করে তাদের দেহের অংশ প্রেসার কুকারে সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলতেন পান্ধের এবং তাঁর বা়ড়ির পরিচারক সুরেন্দ্র। পান্ধেরের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কালগুলির মধ্যে একটি ছিল বাঙালি তরুণী পিঙ্কি সরকারের কঙ্কাল। অভিযোগ ছিল, যৌন নির্যাতনের পরে খুন করা হয় তাঁকে। সেই মামলাতেই পান্ধের এবং কোহলিকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছিলেন সিবিআই আদালতের বিশেষ বিচারক পবন তিওয়ারি।
যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে নিঠারিকাণ্ডের ১৯টি মামলার মধ্যে তিনটি মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ১৬টি মামলার মধ্যে সাতটিতে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয় কোহলিকে। পান্ধের অবশ্য জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন। পরে পিঙ্কি খুনের মামলায় তাঁকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেই মামলাতেই দুই মূল অভিযুক্ত পান্ধের এবং কোহলির ফাঁসির সাজা সোমবার রদ করল ইলাহাবাদ হাই কোর্ট। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ২০০৬ থেকে কোন পথ ধরে এগিয়েছে নিঠারিকাণ্ডের তদন্ত।
নিঠারিকাণ্ডের সূত্রপাত ২০০৫-’০৬ সাল নাগাদ। নয়ডার নিঠারি গ্রাম থেকে নিখোঁজ হতে শুরু করে বেশ কয়েক জন কিশোর-কিশোরী। সেই সংখ্যা বাড়তে থাকায় ঘটনাটি সকলের নজরে আসে। তদন্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্র ধরে তদন্তকারী আধিকারিকেরা পৌঁছে যান পান্ধেরের বাংলোয়। এর পর থেকেই একে একে ‘জট’ খুলতে থাকে নিঠারিকাণ্ডের।
নয়ডার ৩১ নম্বর সেক্টরের গ্রাম নিঠারি। এই গ্রামে ২০০৫-এর গোড়ার দিক থেকেই অস্বাভাবিক ভাবে অনেক কিশোর-কিশোরী এবং শিশু নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ উঠে আসতে থাকে। এই গ্রাম থেকে শিশুদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে থানায় একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়। নিখোঁজদের পরিবারের অভিযোগ ছিল, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জন্য অনেক দিন পর্যন্ত এই রহস্যের কোনও কিনারা হয়নি।
পেশায় ব্যবসায়ী মণীন্দ্র সেক্টর ৩১-এর ডি-৫ বাংলোর মালিক ছিলেন। সুরেন্দ্র নামে এক যুবক ২০০৩ সালে তাঁর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দেন।
২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রিম্পা হালদার নামে এক ১৪ বছর বয়সি কিশোরী নিঠারি গ্রাম থেকে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায়। তার বাবা-মা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালেও বিশেষ কোনও সুবিধা হয়নি।
ওই বছরেরই মার্চ মাসে মণীন্দ্রের বাংলোর পিছনের নর্দমায় প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়া একটি কাটা হাত মেলে। শুরু হয় পুলিশি তদন্ত। তদন্ত শেষে পুলিশ দাবি করে, কোনও জন্তু মুখে করে এনে এই হাতটি ওখানে ফেলে গিয়েছে। উদ্বেগের কিছু হয়নি বলে গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করে পুলিশ।
২০০৬ সালের ৭ মে নিঠারি গ্রামের পায়েল নামের আরও এক তরুণী তাঁর বাবা নন্দলালকে বলেন যে, তিনি মণীন্দ্রের বাংলোয় যাচ্ছেন। কিন্তু তার পর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। পায়েলের বাবা তাঁকে খুঁজতে মণীন্দ্রের বাংলোয় গেলে গৃহকর্মী সুরেন্দ্র তাঁকে জানান, পায়েল সেখানে আসেননি এবং তিনি এই বিষয়ে কিছু জানেন না।
নন্দলালের অভিযোগ ছিল, মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ দায়ের করতে থানায় গেলে পুলিশ তাঁর অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এক মাস ধরে পুলিশ এবং মণীন্দ্রের সঙ্গে কথা বলার পরও কোনও সুরাহা না হওয়ায় তিনি ২০০৬-এর জুন মাসে নয়ডার তৎকালীন এসএসপি-র কাছে গিয়ে পুরো বিষয়টি জানান।
এসএসপির নির্দেশে পুলিশ নন্দলালের মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ নথিভুক্ত করে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে নেমে পুলিশ দেখে, পায়েলের মোবাইল ফোন তখনও চালু ছিল এবং কেউ এই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছিলেন। তদন্ত চলাকালীন পুলিশ এ-ও জানতে পারে যে, নিখোঁজ হওয়ার এক দিন আগে পায়েল এবং সুরেন্দ্রের মধ্যে ফোনে কথা হয়।
এর পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুরেন্দ্রকে আটক করলেও পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশও সুরেন্দ্রের বিরুদ্ধে ফোনে কথা বলা ছাড়া আর কোনও প্রমাণ খুঁজে বার করতে পারেনি। পুলিশের তদন্তের গতিতে বিরক্ত হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন নন্দলাল। আদালত পুলিশকে মামলাটির বিশদ তদন্ত করার নির্দেশ দেয়।
কিছু দিন তদন্ত চালিয়ে পুলিশ মণীন্দ্রের বাংলোর পিছনের নর্দমা থেকে নরকঙ্কাল ভর্তি অনেকগুলি প্লাস্টিকের ব্যাগ উদ্ধার করে। গ্রেফতার হন মণীন্দ্র এবং সুরেন্দ্র। তাঁদের গ্রেফতারের পরের দিন বাংলোর পাশের একটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে অনেকগুলি নরকঙ্কাল উদ্ধার হয়।
মণীন্দ্রের বাড়ির পাশে নরকঙ্কাল উদ্ধার হওয়া ছাড়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আর বিশেষ কোনও প্রমাণ পুলিশের হাতে আসেনি। তবে এই ঘটনায় দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যায়। অপরাধীদের বিচারের দাবি উঠতে থাকে বিভিন্ন মহলে।
পায়েল নিখোঁজ মামলায় তদন্তের জট খোলে নিঠারির নিখোঁজ হওয়া বাকি শিশু এবং মহিলাদের ঘটনারও। জনরোষে চাপে পড়ে উত্তরপ্রদেশ সরকার এই মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়।
৬০ দিনের পুলিশ হেফাজতের পরেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ খুঁজে বার করতে পারেনি সিবিআই। কিন্তু এর পরই হঠাৎ সিবিআইয়ের তরফে জানানো হয়, সুরেন্দ্র দোষ স্বীকার করে বয়ান দিতে রাজি। জেলাশাসকের উপস্থিতিতে সুরেন্দ্রর বয়ান রেকর্ড করা হয়। তদন্তকারী সংস্থা দাবি অনুযায়ী, সুরেন্দ্র বয়ানে যা জানিয়েছিলেন, সেই নৃশংসতার কথা শুনলে গা শিউরে উঠবে।
তদন্তকারী আধিকারিকদের দাবি ছিল, সুরেন্দ্র নাকি তার স্বীকারোক্তিতে জানান যে, তিনি বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে বাড়িতে ডেকে এনে তাদের খুন করতেন। সুরেন্দ্র নাকি এ-ও স্বীকার করেছিলেন যে, খুনের পর তিনি মৃতদেহগুলির সঙ্গে সঙ্গম করতেন এবং শেষে মৃতদেহগুলি কেটে রান্না করা হত। সব শেষে নাকি কঙ্কালগুলি বাংলোর পিছনের নর্দমায় ফেলে দিয়ে আসতেন সুরেন্দ্র।
এই তদন্ত চলাকালীন আরও কিছু মানবকঙ্কাল উদ্ধার করা হয় মণীন্দ্রের বাংলো চত্বরে। সেই কঙ্কালের মধ্যেই ছিল বাঙালি তরুণী পিঙ্কি সরকারের কঙ্কাল। সিবিআই তদন্তে উঠে আসে, পান্ধেরের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন পিঙ্কি। যৌন নির্যাতনের পরে খুন করা হয় তাঁকে। তার পর তাঁর দেহ রান্না করে খেয়ে ফেলেন পান্ধের এবং সুরেন্দ্র। সুরেন্দ্র দোতলার কলঘরে তাঁকে খুন করেন। তার পর তাঁর মাথা কেটে বাকি দেহ প্রেশার কুকারে রান্না করে খেয়ে ফেলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
২০০৭ সালের এপ্রিলে পিঙ্কির জামাকাপড় শনাক্ত করেন তাঁর বাবা-মা। পরে সুরেন্দ্র নিজেই পিঙ্কির চটিজোড়া শনাক্ত করেন। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, অন্য মামলাগুলিতেও তিনি নিজেই শিশুদের ধর্ষণ, খুন করে তাদের খেয়ে ফেলার কথা স্বীকার করেছিলেন।
এর মধ্যেই সিবিআই সন্দেহ করে, নিঠারিকাণ্ডে শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের যোগ রয়েছে। মণীন্দ্রের বাড়ি থেকে ক্যামেরা লাগানো ল্যাপটপ এবং কিছু কামোত্তেজক বই উদ্ধার করা হয়। মণীন্দ্রের সঙ্গে কিছু নিরাবরণ শিশুদের ছবিও ওই বাংলো থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে পরে জানা যায়, ছবিগুলি মণীন্দ্রের নাতি-নাতনিদের।
সুরেন্দ্রের পাশাপাশি মণীন্দ্রেরও শিশুদের যৌন নির্যাতন করার প্রবণতা ছিল বলেও মনে করেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা। এ-ও অভিযোগ ওঠে যে, মণীন্দ্র মাঝেমধ্যেই বাড়িতে যৌনকর্মীদের ডেকে পাঠাতেন।
এই ঘটনায় অঙ্গ পাচারের কোনও চক্র কাজ করছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে শুরু করেন সিবিআই আধিকারিকেরা। পুলিশ অভিযুক্তের বাড়ির কাছে বসবাসকারী এক চিকিৎসকের বাড়িতে অভিযান চালায়। ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এর আগেও ১৯৯৮ সালে অঙ্গ পাচার করার অভিযোগ উঠেছিল।
অভিযুক্ত মণীন্দ্র এবং সুরেন্দ্র, দু’জনেরই ব্রেন ম্যাপিং এবং পলিগ্রাফ পরীক্ষা করানো হয়। এর পর সুরেন্দ্র অপরাধের কথা স্বীকার করলেও মণীন্দ্রকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, মোট ১৯টি নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে বাংলো চত্বর থেকে। এদের মধ্যেই বেশির ভাগই কিশোরীদের কঙ্কাল। উদ্ধার হওয়া নরকঙ্কালের মধ্যে ১১টি ছিল কিশোরীদের। সিবিআই সেই সময় জানিয়েছিল, মোট ১৫টি খুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্ত চলাকালীন সুরেন্দ্র তাঁর মনিব মণীন্দ্রকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন বলেও সিবিআই আধিকারিকেরা দাবি করেন।
২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত মণীন্দ্র এবং সুরেন্দ্রকে ১৪ বছর বয়সি রিম্পাকে খুন করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অভিযোগ করা সত্ত্বেও গুরুত্ব না দেওয়ায় এবং কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ এনে স্থানীয় পুলিশকর্মীদের সাসপেন্ড করা হয়।
এর পর ২০১৭ সালেও পরিচারিকা পিঙ্কিকে অপহরণ, ধর্ষণ, খুন, প্রমাণ লোপাটের ঘটনায় পান্ধের এবং কোহলিকে দোষী সাব্যস্ত করে গাজিয়াবাদের বিশেষ সিবিআই আদালত। ঘটনাটিকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে উল্লেখ করে তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক পবন তিওয়ারি।
এর মধ্যেই মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচতে অনেক বার আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছে মণীন্দ্র। তবে বার বার তা খারিজ করা হয়েছে। সোমবার নিঠারিকাণ্ডের সেই দুই মূল অভিযুক্ত মণীন্দ্র এবং সুরেন্দ্রের ফাঁসির সাজা রদ করল ইলাহাবাদ হাই কোর্ট। সুরেন্দ্রকে ১২টি মামলায় এবং মণীন্দ্রকে দু’টি মামলায় ‘বেকসুর’ ঘোষণা করা হয়েছে বলে আদালত সূত্রে খবর। তাতেই তাঁদের ফাঁসির সাজা রদ হল।
—ফাইল চিত্র।