কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে পা। মুখে ফুটে উঠেছে বলিরেখা। ফলে শুরু হয়েছে নানা যান্ত্রিক সমস্যা। যা দেখে মহাকাশচারীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তাঁদের মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়া এবং নিরাপদে ফিরে আসা নিয়ে উঠে গিয়েছে প্রশ্ন।
নভোচরেরা জানিয়েছেন, বয়সের ভারে রীতিমতো ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএস)। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো বহুল ব্যবহারে স্পেসস্যুটগুলির অবস্থাও তথৈবচ।
চলতি বছরের ৮ নভেম্বর বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’র মহাকাশচারী ম্যাথু ডমিনিক। আইএসএসের ক্রু-৮ দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘দশকের পর দশক ধরে স্পেস স্টেশন এবং স্পেসস্যুটগুলি ব্যবহার করার ফলে সেগুলিতে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে।’’
নাসার মহাকাশচারীদের কাছে স্পেসস্যুট ‘এক্সাভেহিক্যুলার মোবালিটি ইউনিটি’ (ইএমইউ) নামে পরিচিত। মহাকাশচারী ডমিনিক বলেছেন, ‘‘মহাকাশে চলাফেরার কথা মাথায় রেখে এগুলির নকশা তৈরি করা হয়েছে। অত্যধিক ব্যবহারে এ বার এগুলিতে বয়সের ছাপ ফুটে উঠছে।’’
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন এবং স্পেসস্যুটে যান্ত্রিক গোলযোগ যে কতটা উদ্বেগের তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন নাসার ওই নভোচর। ডমিনিকের কথায়, ‘‘আমাদের কোনও স্পেসস্যুট কিন্তু ‘স্প্রিং চিকেন’-এর মতো নয়। বহুল ব্যবহারে এগুলির হার্ডঅয়্যারে সমস্যা ধরা পড়ছে।’’
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গবেষণামূলক কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্পেসস্যুট একটি অত্যাবশ্যক উপকরণ। এর সঙ্গে মহাকাশচারীদের সুরক্ষা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেটা জেনেও কেন নাসার মতো প্রতিষ্ঠানের নভোচরদের পুরনো স্পেসস্যুট ব্যবহার করতে হচ্ছে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
স্পেসস্যুটের পাশাপাশি আইএসএসে ‘এয়ার লিক’-এর বিষয়টিও তুলে ধরেছেন ডমিনিক। সেই ত্রুটি ঠিক করতে নাসা এবং রুশ মহাকাশচারীদের রীতিমতো কালঘাম ছুটে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডমিনিকের কথায়, ‘‘আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন আরাম করার জায়গা নয়। সেখানে একমাত্র স্মার্ট ব্যক্তিরাই কাজ করতে পারেন। সবটা মেনেই আমরা ক্রু হিসাবে সেখানে থেকেছি এবং কাজ চালিয়ে গিয়েছি।’’
এ বছরের ২৫ অক্টোবর মহাকাশচারীদের নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে ‘ক্রু-৮’। এর পরই মহাকাশযাত্রার একাধিক চ্যালেঞ্জের কথা সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন ডমিনিক। মহাকাশচারীদের সুরক্ষার সঙ্গে কোনও রকমের আপস করা হচ্ছে না বলে অবশ্য আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন যে ‘নিরাপদ’ হাতে রয়েছে, তা জানাতেও ভোলেননি নাসার নভোচর। আর এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সহযোগিতার কথাও জানাতে ভোলেননি ডমিনিক।
২০৩০ সাল পর্যন্ত মহাশূন্যে নিজের কাজ চালিয়ে যাবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। কিন্তু তার আগে এটিকে ঘিরে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে নাসা। মহাকাশযানটির রাশিয়ান সার্ভিস মডিউল ট্রান্সফার টানেলে চিড় ধরেছে। যার জেরে আইএসএসে ‘এয়ার লিক’-এর সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
২০২১ সালে প্রথম বার আইএসএসের ট্রান্সফার টানেলের চিড় এবং ‘এয়ার লিক’-এর ব্যাপারটি নাসার নজরে আসে। যা ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটির উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের মেরামতির জন্য রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এর সাহায্য নিচ্ছে নাসা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর চিড় সারিয়ে তোলা যায়নি। এ বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নাসার অফিস অফ ইনস্পেক্টর জেনারেল বলেন, ‘‘আইএসএসের কাঠামোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা সন্দিহান।’’
সূত্রের খবর, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের বয়স বেড়ে যাওয়ায় প্রতিস্থাপনযোগ্য যন্ত্রাংশগুলি পেতে সমস্যা হচ্ছে। সরবরাহকারী বহু সংস্থাই এগুলির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপনের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে নাসা।
আর পাঁচ বছর আইএসএসকে কর্মক্ষম রাখার ক্ষেত্রে যন্ত্রাংশের সমস্যাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন মহাকাশচারীরা। মহাকাশ স্টেশনের ক্রুদের বেঁচে থাকার জন্য পণ্য পরিবহণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এর লঞ্চ ভেহিকলটিকেও ঠিক রাখা নাসার কাছে কঠিন হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের লঞ্চ ভেহিকল ব্যর্থ হলে মহাকাশচারীদের জন্য পণ্য পরিবহণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর তখন অন্য সংস্থাগুলির কাছে সাহায্য চাইতে হবে নাসাকে। যা একেবারই না-পসন্দ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার।
আর তাই আইএসএসকে ত্রুটিমুক্ত করে সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নাসা। সেখানে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে বোয়িং স্টারলাইন বিলম্ব করায় মহাকাশচারীদের ঝুঁকি বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটির খরচও।
প্রায় ২৬ বছর আগে, ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর পৃথিবীর নিম্ন কক্ষের উদ্দেশে রওনা হয় আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। এতে একসঙ্গে গবেষণামূলক কাজ করছেন আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, জাপান ও কানাডার মহাকাশচারীরা।
আইএসএসটি দৈর্ঘ্যে ৭২.৮ মিটার। এর উচ্চতা এবং প্রস্থ যথাক্রমে ২০ মিটার ও ১০৮.৫ মিটার। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি অতিকায় কৃত্রিম উপগ্রহ। এর মধ্যে মহাকাশচারীরা লম্বা সময় থাকতে পারেন।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা। তার পরই আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার কথা ঘোষণা করে মস্কো। এর ফলে আইএসএসে যন্ত্রাংশ সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা প্রকট হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।