দেশ ছাড়ছেন পাকিস্তানি যুবকেরা। চাকরির চেষ্টায় বা চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে কম করে ১০ লক্ষ দক্ষ শ্রমিক পাকিস্তান ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে হিসাবরক্ষক এবং ম্যানেজার। এঁদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
কোনও দেশের মেধাবীরা যদি ভাল প্রস্তাব পেয়ে বাইরের দেশে চলে যান, তা হলে তাকে ‘ব্রেন ড্রেন’ বলে। যেমনটা হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে।
কিন্তু কেন এ ভাবে ‘ব্রেন ড্রেন’ হচ্ছে পাকিস্তানে? কেন নিজেদের দেশ ছেড়ে পালানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী যুবারা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি। সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনেও তেমনটা উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, বিগত প্রায় আড়াই বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক হাল বেহাল। সে কথা এখন আর কারও অজানা নয়। বহু দিন ধরেই সে দেশ আর্থিক সঙ্কটের মুখে রয়েছে। তা থেকে বেরিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি ভারতের প্রতিবেশী।
তার মধ্যেই সেই দেশের সরকার উল্টেছে। ক্ষমতা গিয়েছে তদারকি সরকারের হাতে। নতুন সরকার গড়ার জন্য নির্বাচন হয়েছে। ফলঘোষণা হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচিত হয়েছেন।
তার পরেও অর্থনৈতিক টানাপড়েনে জর্জরিত পাকিস্তান। ইসলামাবাদের মাথায় যে পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চেপেছে, তা-ও কমেনি। যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে সে দেশের বাজারে। পাকিস্তানে জিনিসপত্রের মূল্যও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সাধারণ জিনিসপত্র কিনতে ছেঁকা খাচ্ছেন পাকিস্তানের আমজনতা।
ব্লুমবার্গের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ থেকে রান্নার গ্যাস এবং পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়েছে পাকিস্তানের সরকার। যার ঠেলা সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে সে দেশের সাধারণ মানুষকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমনও অনেক পাকিস্তানি রয়েছেন যাঁদের ঘরভাড়া এবং বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রায় একই পরিমাণ টাকা গুনতে হচ্ছে।
অন্য একটা সমীক্ষা অনুযায়ী, পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, ভারতের প্রতিবেশী দেশে সংসার চালাতে কেউ কেউ একসঙ্গে দু’-তিনটে চাকরি করছেন। কেউ কেউ আবার পরিচিতদের কাছ থেকে ধারের পর ধার করে যাচ্ছেন।
ওই সমীক্ষা বলছে, পাকিস্তানের প্রায় ৭৪ শতাংশ মানুষকে মাসের খরচ চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ শতাংশ।
বেহাল অবস্থা পাকিস্তানের চাকরির বাজারেরও। চাকরি তো নেই-ই, তার উপর আবার সম্প্রতি দেড় লাখ সরকারি কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা নিয়ে আঙুল উঠেছে শাহবাজ শরিফ সরকারের দিকে।
দেড় লাখ সরকারি কর্মচারীর চাকরি বাতিলের পাশাপাশি ছ’টি মন্ত্রক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসলামাবাদ। ২৯ সেপ্টেম্বর যা ঘোষণা করেছিলেন পাক অর্থমন্ত্রী।
যে মন্ত্রকগুলি বন্ধ হচ্ছে সেখানকার সিংহভাগ কর্মীকেই ছাঁটাইয়ের তালিকায় রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়াও খরচ কমাতে দু’টি মন্ত্রক মিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল পাক সরকার।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, পাকিস্তানের ‘হাঁড়ির হাল’ দেখে বিদেশি নামীদামি সংস্থারাও সে দেশে বিনিয়োগ করতে তেমন আগ্রহী নয়। অনেক বিদেশি সংস্থা আবার ধীরে ধীরে ব্যবসার জাল গোটাচ্ছে সে দেশ থেকে। ফলে পাকিস্তানের অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতীই পড়াশোনা শেষ করে বেকার বসে রয়েছেন।
ইসলামাবাদের একটি চিন্তন শিবিরের বিশ্লেষণ, পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ ফেলেছে সে দেশের ঋণ-পরিস্থিতি। পাকিস্তানের ঋণের বোঝার কারণে ইতিমধ্যেই সে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বিভিন্ন সমীক্ষার হিসাব বলছে, ২০১১ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু ঋণ ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি হ্রাস পেয়েছে ৬ শতাংশ। পাকিস্তানে ঋণ এবং আয়বৃদ্ধির হারের মধ্যে বৈষম্যের কারণেও পাকিস্তানের অর্থনীতির হাল খারাপ হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
পাকিস্তানের হাতে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারও তলানিতে ঠেকেছে। চরম আর্থিক সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল খোদ আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ)। তাদের কাছেও হাত পেতেছিল ইসলামাবাদ। সেই টাকা দেওয়ার শর্ত হিসাবে পাকিস্তানকে বেশ কিছু কড়া সিদ্ধান্ত নিতে বলে আইএমএফ।
আইএমএফের থেকে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ বাবদ পেতে চলেছে পাকিস্তান। চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর যার অনুমোদন দিয়েছে এই আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা।
তবে ঋণ পেতে পাক সরকারকে খরচ কমাতে বলেছিল আইএমএফ। পাশাপাশি, কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি, কৃষি ও রিয়্যাল এস্টেটের মতো অপ্রচলিত খাতে কর বসানো এবং ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার মতো শর্তও মানতে হচ্ছে ইসলামাবাদকে।
সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এমনই যে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নাকি পাকিস্তান ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সে দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী যুবক-যুবতীরা। অনেকেরই চিন্তা, পাকিস্তানে থেকে গেলে কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যেতে পারে তাঁদের। পাকিস্তানের বহু মানুষের মতো জীবন কাটাতে হতে পারে দারিদ্রের মধ্যে।
আর সেই কারণেই মোটা বেতনের চাকরি এবং সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে দেশ ছাড়ছেন তাঁরা। আর তারই সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি সংস্থাগুলি। ‘ব্রেন ড্রেন’ হয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের।
সব ছবি: সংগৃহীত।