মুদ্রাস্ফীতির কাঁটায় নাজেহাল মধ্যবিত্ত। আর তাই বেশি লাভের আশায় ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের প্রথাগত সঞ্চয়ভিত্তিক প্রকল্পগুলি থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়ে মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করছে তারা। এতে সুদের হার কিছুটা বেশি। তবে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ পুরোপুরি বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ।
মিউচুয়াল ফান্ডে দু’ভাবে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। একটির নাম লাম্পসাম লগ্নি। দ্বিতীয়টিকে বলা হয় সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি। লাম্পসামের ক্ষেত্রে গ্রাহককে একবারে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। সাধারণত বোনাস বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া টাকা আমজনতাকে এই খাতে লগ্নি করতে দেখা গিয়েছে।
মিউচুয়াল ফান্ডের লাম্পসাম লগ্নিতে ঝুঁকির মাত্রা অনেকটাই বেশি। এটি পুরোপুরি শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনের উপর নির্ভরশীল। অন্য দিকে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ধারাবাহিক ভাবে এসআইপিতে লগ্নি করতে হয়। তবে একজন গ্রাহক ইচ্ছা করলে লাম্পসাম এবং এসআইপি— দু’টি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করতে পারেন।
এসআইপিতে আর্থিক দিক থেকে লোকসানের আশঙ্কা তুলনামূলক ভাবে কম। আর তাই এতে লগ্নির পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জনপ্রিয় এসআইপি প্রকল্পগুলিতে গ্রাহকদের প্রতি মাসে বিনিয়োগ করতে হয়। তবে দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক এবং বার্ষিক ভাবেও লগ্নির সুযোগ রয়েছে।
সমস্ত সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে দৈনিক, সাপ্তাহিক, ত্রৈমাসিক বা ছ’মাস অন্তর বিনিয়োগের সুবিধা নেই। এ ক্ষেত্রে লগ্নির আগে কত দিন অন্তর টাকা জমা করতে হবে, তা গ্রাহককে ভাল ভাবে জেনে নিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, বিনিয়োগকারী ইচ্ছা করলে টাকার অঙ্ক একই রাখতে পারেন। আবার লগ্নির পরিমাণ বৃদ্ধি বা হ্রাসের সুযোগও রয়েছে।
কোনও কারণে আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়লে এসআইপি বন্ধ করতে পারবেন গ্রাহক। পরে ফের নতুন করে এসআইপি চালু করার সুযোগ পাবেন তিনি। লগ্নিকারী ইচ্ছা করলে প্রতি ছ’মাস বা এক বছর অন্তর এসআইপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারেন। বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এটি করা গেলে বলা বাহুল্য, বাড়বে রিটার্নের অঙ্ক।
এসআইপি পুরোপুরি শেয়ার বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে এতে লগ্নির ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও সময়ের ব্যাপার নেই। বছরের যে কোনও সময়েই এতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এসআইপির মাধ্যমে একজন গ্রাহক মিউচুয়াল ফান্ডের নিট সম্পদ মূল্য বা নেট অ্যাসেট ভ্যালু ইউনিট কিনে থাকেন। এর দাম প্রতি দিন পরিবর্তিত হয়।
দৈনিক ২৫০ টাকা এবং মাসে ৭,৫০০ টাকা এসআইপিতে লগ্নির ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, দৈনিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ৩৬৫ দিন লগ্নি করতে হবে। লিপ ইয়ার হলে বিনিয়োগের দিনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৬৬। অন্য দিকে মাসে ৭,৫০০ টাকা করে এসআইপিতে জমা করলে বছরে মোট ৩৬০ দিন লগ্নি করবেন ওই গ্রাহক। এ ক্ষেত্রে ৩০ দিনে মাস হিসাব করবে সংশ্লিষ্ট মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থা।
এসআইপিতে বছরে ১২ শতাংশ বা তার বেশি সুদ পাওয়া যেতে পারে। এতে গ্রাহক তাঁর লগ্নির উপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ পাবেন। এখন দৈনিক ২৫০ টাকা করে এসআইপিতে ২০ বছর লগ্নি করলে মোট বিনিয়োগের অঙ্ক দাঁড়াবে ১৮ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এর উপর সুদ বাবদ ৫৭ লক্ষ ৯৫ হাজার ৯৯০ টাকা পাবেন তিনি। অর্থাৎ, ২০ বছর শেষে সুদেমূলে মিলবে ৭৬ লক্ষ ২০ হাজার ৯৯০ টাকা। উল্লেখ্য, এখানে সুদের হার বছরে সুদের হার ১২ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে।
একই ভাবে ২৫ বছরের ক্ষেত্রে দৈনিক ২৫০ টাকা করে বিনিয়োগে মোট লগ্নি বেড়ে দাঁড়াবে ২২ লক্ষ ৮১ হাজার ২৫০ টাকা। বছরে ১২ শতাংশ সুদে মেয়াদ শেষে গ্রাহক পাবেন ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ১০ হাজার ২০১ টাকা। অর্থাৎ সুদ বাবদ ১ কোটি ২২ লক্ষ ২৮ হাজার ৯৫১ টাকা ঢুকবে ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে।
এই হিসাবে ৩০ বছর শেষে এসআইপি থেকে ২ কোটি ৭০ লক্ষ ৬১ হাজার ৯৪২ টাকা পাবেন গ্রাহক। সে ক্ষেত্রে তাঁর মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৭ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর সুদ বাবদ ২ কোটি ৪৩ লক্ষ ২৪ হাজার ৪২৪ টাকা পাবেন সংশ্লিষ্ট লগ্নিকারী।
কিন্তু যদি কেউ মাসে ৭,৫০০ টাকা করে এসআইপিতে বিনিয়োগ করেন তা হলে ২০ বছরে ১৮ লক্ষ টাকা জমা করবেন তিনি। বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদের হারে সেখান থেকে তাঁর প্রাপ্ত রিটার্নের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৬ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬০৯ টাকা। অর্থাৎ সুদেমূলে ৭৪ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬০৯ টাকা পাবেন তিনি।
এর পর অতিরিক্ত আরও পাঁচ বছর সংশ্লিষ্ট এসআইপিতে লগ্নি করতে গ্রাহকের মোট বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়াবে ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। ফলে রিটার্নের পরিমাণ ১ কোটি ৪২ লক্ষ ৩২ হাজার ২৬৩ টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। ৩৫ বছর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এসআইপিতে বিনিয়োগ করলে সুদেমূলে ২ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭৪ হাজার ৩৫৩ টাকা পাবেন ওই ব্যক্তি।
আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এসআইপিতে বিনিয়োগ শুরু করার আগে ব্যয়ের হিসাব এবং আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে, সন্তানের শিক্ষার খরচের কথা ভেবে অনেকে এসআইপি করে থাকেন। এতে ২০ বছর পর ২৫ লক্ষ টাকা বা ২৫ বছর পর ৩৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হতে পারে। এসআইপি থেকে ওই টাকা পেতে হলে গ্রাহককে কমপক্ষে ৩০ বছরের জন্য এতে লগ্নি করতে হবে।
সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে বিশেষজ্ঞেরা দু’-তিনটি মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্পে এসআইপিতে লগ্নির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, বিনিয়োগে বৈচিত্র রাখতেও বলেছেন তাঁরা। বিনিয়োগের আগে কোন তহবিল কেমন মুনাফা দিচ্ছে, সে দিকে নজর দিতে বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
আর্থিক বিশেষজ্ঞেরা কম বয়স থেকে এসআইপিতে লগ্নি শুরু করার কথা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে কম টাকা বিনিয়োগ করে অবসরের পর মোটা অর্থ হাতে পাওয়ার সুযোগ পাবেন গ্রাহক। বেশি বয়সে এসআইপি শুরু করে অনেকটা রিটার্ন পেতে হলে বাড়াতে হবে লগ্নির পরিমাণও।
দিনে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে এসআইপি শুরু করার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনই ধারাবাহিক ভাবে এতে লগ্নি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের কথায়, এসআইপি থেকে ভাল লাভ পেতে হলে চাই ধৈর্য। সময়ের আগে মূলধন তুলে নিলে কখনওই সেটা পাবেন না গ্রাহক।
আর্থিক বিশ্লেষকদের কথায়, শেষ তিন মাস বাদে দু’বছর ধরে যথেষ্ট চাঙ্গা রয়েছে ভারতের শেয়ার বাজার। এর সুফল পাচ্ছেন মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নিকারীরা। এসআইপিতে কম করে হলেও ১২ শতাংশ সুদ মিলছে। বাজার আরও চড়লে এই অঙ্ক ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে পৌঁছনোর সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুদেমূলে প্রাপ্তির পরিমাণ যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।