সিমেন্টের পর এ বার তামা। ফের আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে দেশের অন্যতম ধনী শিল্পপতি গৌতম আদানি। একচেটিয়া তামা ব্যবসার চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখতে বিপুল লগ্নি করছে এই দুই শিল্প গোষ্ঠী। তাঁদের এ হেন পদক্ষেপ ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) মার্চ মাসে গুজরাটের মুন্দ্রায় একটি তামা শোধনাগারের প্রথম ইউনিট চালু করে আদানি এন্টারপ্রাইজ়ের একটি শাখা সংস্থা। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির নাম ‘কচ্ছ কপার’ রেখেছেন গৌতম। মোট দু’টি পর্যায়ে শোধনাগারটিকে গড়ে তুলছেন তিনি। আদানি গোষ্ঠী জানিয়েছে, ২০২৯ সালের মধ্যে ‘কচ্ছ কপার’ থেকে পরিশোধিত তামা উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ লক্ষ টন।
প্রথম পর্যায়ের তাম্র শোধনাগারের ইউনিটটি চালু করতে ১২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন শিল্পপতি গৌতম আদানি। বর্তমানে ‘কচ্ছ কপার’-এর মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টন পরিশোধিত তামা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন তিনি। একে বিশ্বের বৃহত্তম তাম্র উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
আদানি গোষ্ঠী জানিয়েছে, তাদের উচ্চাভিলাষী ‘সবুজ শক্তি’র (গ্রিন এনার্জি) ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিপুল পরিমাণে পরিশোধিত তামার প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে মুন্দ্রায় ‘কচ্ছ কপার’কে গড়ে তুলছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সংস্থার শক্তিশালী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তামা ব্যবসায় সারা দুনিয়ায় নিজের জায়গা পাকা করার স্বপ্ন দেখছেন শিল্পপতি গৌতম আদানি।
সূত্রের খবর, তামা উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে অস্ট্রেলিয়ার খনি সংস্থা বিএইচপির সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরে ফেলেছে ‘কচ্ছ কপার’। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির থেকে মুন্দ্রার কারখানার জন্য বছরে ১০ লক্ষ ৬০ হাজার টন তামা আমদানি করতে পারে আদানি গোষ্ঠী। বর্তমান বাজারমূল্যে এই চুক্তি বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি টাকার হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এই নিয়ে আদানি গোষ্ঠী বা অস্ট্রেলীয় সংস্থাটির তরফে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, তামা শিল্পে আদানিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দিতে পারে আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সংস্থা ‘হিন্দালকো’। এ ছাড়াও রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হিন্দুস্তান কপার’। এ দেশের খনি থেকে তাম্র উত্তোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই দুই সংস্থা। মুন্দ্রার ধাঁচে আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীও তামা শোধনাগার চালু করলে শিল্পপতি গৌতম যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন, তা বলাই বাহুল্য।
আদানি হোক বা আদিত্য বিড়লা, দেশের দুই নামী শিল্প সংস্থার তামা শিল্পের পিছনে দৌড়নোর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তামার চাহিদা। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ, ব্যাটারিচালিত গাড়ি, মহাকাশ গবেষণা বা উন্নত হাতিয়ার নির্মাণে এই ধাতুটির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
‘ইন্টারন্যাশনাল কপার অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’ বা আইসিএআইয়ের করা সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ’২১ আর্থিক বছরে এ দেশের বাজারে তামার চাহিদা ছিল ৯৭৮ কিলোটন। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক বেড়ে ১,৭১৮ কিলোটনে পৌঁছে গিয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর (পড়ুন ২০২৪) ভারতে তামার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৩ শতাংশ।
এ দেশের খনি সংস্থাগুলির মধ্যে ‘হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড’ বছরে গড়ে এই ধাতুটি উত্তোলন করে ৬৮ হাজার ৫০০ টন। আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সংস্থা ‘হিন্দালকো’র ক্ষেত্রে পরিমাণটি আনুমানিক পাঁচ লক্ষ টন। এ ছাড়া বছরে ৪.৬ লক্ষ টন তামা খনি থেকে উত্তোলন করে বেদান্ত গ্রুপের সংস্থা ‘স্টারলাইট কপার’।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, ভারতে তাম্র উৎপাদনের সঙ্গে এর চাহিদার যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। সেই দূরত্ব ঘোচাতে সংশ্লিষ্ট ধাতুটির আমদানির সূচক দিন দিন ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। আর তাই কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশের উপর তামার ব্যাপারে নির্ভরশীল থাকতে রাজি নয় নয়াদিল্লি। ধাতুটির সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে নতুন নতুন বাজারের অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কেন্দ্র দ্বারা চিহ্নিত ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর মধ্যে তামা অন্যতম। এ দেশে মাথাপিছু তাম্র ব্যবহারের পরিমাণ ০.৬ কেজি। বিশ্বে এর গড় ৩.২ কেজির তুলনায় অনেকটাই কম। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হবে বলে অনুমান বিশ্লেষকদের একাংশের।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত পরিশোধিত তামার অন্যতম রফতানিকারী দেশ ছিল ভারত। ২০১৮ সালে তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে তামা উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় বেদান্ত গোষ্ঠীর সংস্থা ‘স্টারলাইট কপার’। এর পরই দ্রুত পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। কারণ ওই কারখানায় তালা পড়ায় ঘরের মাটিতে তাম্র উৎপাদন কমেছে প্রায় ৪৬ শতাংশ।
২০১৮-’১৯ আর্থিক বছর থেকে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে তামা আমদানি শুরু করে ভারত। গত ১৮ বছরের মধ্যে যা ছিল প্রথম। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা মূল্যের তামা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ঘরের মাটিতে এনেছে নয়াদিল্লি।
আইসিএআই জানিয়েছে, ২০১৮-’১৯ সালে ভারতে পরিশোধিত তামার উৎপাদন ৯.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। চলতি বছরে (পড়ুন ২০২৫) এটি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে ২০২৩ সালে ঘরোয়া বাজারে তামার চাহিদা বৃদ্ধি পায় ১৬ শতাংশ।
সমীক্ষকদের দাবি, কোভিড অতিমারি কেটে যাওয়ার পর থেকে ভারতের বাজারে তামার চাহিদা ফের বাড়তে শুরু করেছে। রেল এবং মেট্রোয় এর ব্যবহার ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে তামার ব্যবহার বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাণে সংশ্লিষ্ট ধাতুটির চাহিদা ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
ভারতের তাম্র শিল্প নিয়ে সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের কাছে মুখ খুলেছেন এএনজ়েড ব্যাঙ্কিং গ্রুপের কমোডিটি স্ট্র্যাটেজিস্ট সোনি কুমারী। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরের মাটিতে তামার উৎপাদন এ দেশের বাজারে তামার চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই তাম্র আকরিকের আমদানির উপর নয়াদিল্লির নির্ভরশীলতা বাড়ছে।’’ গত পাঁচ বছর ধরে ভারতে তামার আমদানি ধারাবাহিক ভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গুজরাটের মুন্দ্রায় আদানিদের তাম্র উৎপাদন কেন্দ্র এই শিল্পে গতি আনবে বলে স্পষ্ট করেছেন সোনি কুমারী। তিনি বলেছেন, ‘‘কচ্ছ কপার যদি বছরে ৮০ হাজার টন করে পরিশোধিত তামা উৎপাদন করতে পারে তা হলে খুব দ্রুত আমরা আবার ২০১৭ সালের অবস্থায় ফিরে যাব। সে ক্ষেত্রে ২০২৬ বা ২০২৭ সাল থেকে ফের তামা রফতানির বাজারে বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠবে নয়াদিল্লি।
তাম্র শিল্পে ভারতের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে চিন। কারণ আকরিক থেকে পরিশোধিত তামা উৎপাদনের জন্য ড্রাগনভূমিতে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন কারখানা। বিশ্লেষকদের দাবি, বেজিঙের আগে এই বাজারে ঢুকে পড়তে পারলে আখেরে লাভ হবে ভারতের। আর সেটা বুঝতে পেরেই আদানি এবং আদিত্য বিড়লার মতো শিল্প গোষ্ঠী এতে লগ্নির অঙ্ক বাড়াচ্ছেন।
বর্তমানে আমদানি করা তামার সিংহভাগই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি থেকে আনছে ভারত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। এ ছাড়া পেরু, পানামা প্রজাতন্ত্র, কানাডা, সৌদি আরব, ব্রাজ়িল এবং তাইল্যান্ড থেকেও তামা আমদানি করে থাকে ভারত।
এ দেশে আমদানি হওয়া তামার ৩৭ শতাংশ আসে চিলি থেকে। ২০ ও ১১ শতাংশ তামা অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কিনে থাকে ভারত। তাম্র আকরিককে পরিশোধিত তামায় বদলে দেওয়ার কারখানা আবার চিলিতে সে ভাবে নেই। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির এই সমস্যাকে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে নয়াদিল্লির।
সম্প্রতি তামা রফতানির নিয়মে কিছু বদল এনেছে ইন্দোনেশিয়া। আগের মতো আর লাগামছাড়া ভাবে এই ধাতুটিকে বিক্রি করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে জাকার্তা। আর তাই সেখান থেকে আমদানি করা তামার মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি থেকে তামা কেনার পরিমাণ কমাতে পারে নয়াদিল্লি।
ভারত-সহ চারটি দেশের সংগঠন ‘কোয়াড’-এর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল অস্ট্রেলিয়া। আর তাই তামার ব্যাপারে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশটির সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক মজবুত করছে নয়াদিল্লি। তামার সংকর সর্বাধিক আমদানি করা হয় জাপান থেকে। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে তানজ়ানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভিয়েতনাম।
এ দেশে আমদানি করা তাম্র সংকর ২৫ শতাংশ আসে টোকিয়ো থেকে। পাশাপাশি তানজ়ানিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ভারতে তামার সঙ্কর সরবরাহ করে যথাক্রমে ২০ এবং ১৩ শতাংশ। ভিয়েতনাম এবং তাইল্যান্ড থেকে আসে মাত্র সাত এবং ছ’শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ঘরের মাটিতে তাম্র শিল্পকে ফের চাঙ্গা করতে ছাঁট তামা কেনার দিকে নয়াদিল্লিকে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি, তামার ক্ষেত্রে কর এবং শুল্ক নীতিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন করতে পারে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে শিল্প গোষ্ঠীগুলি এ ব্যাপারে আরও বেশি করে উৎসাহিত হবে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে বাড়বে লগ্নির মাত্রা।
বছর তিনেক আগে অম্বুজা সিমেন্টকে অধিগ্রহণ করে আদানি গোষ্ঠী। এই শিল্প সংস্থার হাতেই রয়েছে এসিসি সিমেন্ট। এই ক্ষেত্রে আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর আল্ট্রাটেকের সঙ্গে তাদের প্রবল প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ বার সেই একই রকমের প্রতিযোগিতা তাম্র শিল্পেও দেখা যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।