নৌশক্তিতে প্রায় সমকক্ষ দুই দেশ। এ বার আমেরিকার বায়ুসেনাকেও জোর টক্কর দিচ্ছে ড্রাগন। যুদ্ধবিমানের সংখ্যার নিরিখে অচিরেই ওয়াশিংটনের থেকে অন্তত ১২ গুণ এগিয়ে যাবে বেজিং। নতুন বছরের গোড়াতেই এই নিয়ে সরকারকে সতর্ক করলেন যুক্তরাষ্ট্রেরই এক সেনাকর্তা। ফলে সেখানকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের কর্তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
এ বছরের (পড়ুন ২০২৫) ৬ জানুয়ারি চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) বায়ুসেনার শক্তি নিয়ে আশঙ্কার কথা বলতে শোনা গিয়েছে আমেরিকার এডওয়ার্ড এয়ারফোর্স ঘাঁটির ৪১২তম টেস্ট উইংয়ের কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডগ উইকার্টের গলায়। ‘ব্যাক-ইন-দ্য-স্যাডল ডে’ অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধবিমানের দিক থেকে অপ্রত্যাশিত উন্নতি করেছে চিন।’’
উইকার্টের দাবি, ‘‘কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের এলাকায় লড়াকু জেট মোতায়েনের নিরিখে আমেরিকাকে পিছনে ফেলতে চলেছে চিন। ২০২৭ সালের মধ্যে বেজিং এবং ওয়াশিংটনের যুদ্ধবিমানের সংখ্যার অনুপাত দাঁড়াবে ১২ বনাম এক।’’ এতে আগ্রাসী ড্রাগনকে মোকাবিলা করা যে যথেষ্টই কঠিন হবে, তা স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই বায়ুসেনা অফিসার।
এর পাশাপাশি সমুদ্রে নজরদারির ক্ষেত্রে লালফৌজ যে আমেরিকার নৌসেনার থেকে এগিয়ে রয়েছে, তা বকলমে স্বীকার করে নিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উইকার্ট। তাঁর কথায়, ‘‘ওই এলাকায় পিএলএর ২২৫টি বোমারু বিমান অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বাড়াতে বিমানবাহী রণতরী, উভচর হামলাকারী যুদ্ধজাহাজ এবং একাধিক ডুবোজাহাজকে কাজে লাগাচ্ছে বেজিং।’’
এ ছাড়া পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের স্বল্পতার কথাও বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই পদস্থ বায়ুসেনা অফিসার। উইকার্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেজিং এবং ওয়াশিংটনের হাতে থাকা এই ধরনের লড়াকু জেটের সংখ্যার অনুপাত দাঁড়িয়েছে পাঁচ বনাম তিন। সমুদ্রে নজরদারি বিমানের ক্ষেত্রে সেটি তিন বনাম একে গিয়ে ঠেকেছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ডিসেম্বরের মাঝামাঝি মহড়ার নামে হঠাৎ করেই তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলে পিএলএর নৌসেনা। উইকার্ট জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় যুদ্ধাভ্যাস করেনি আর কোনও নৌবাহিনী। গত বছরের জুনে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে মহড়া চালায় আমেরিকার নৌসেনা। তাইওয়ানকে ঘিরতে সেখানে অংশ নেওয়া রণতরীর তুলনায় তিন গুণ বেশি যুদ্ধজাহাজ কাজে লাগায় বেজিং।
২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রথম বার ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রকাশ্যে এনে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেয় চিন। তিন ইঞ্জিন বিশিষ্ট ওই লড়াকু জেটের পোশাকি নাম ‘জে-৩৬’ বলে জানা গিয়েছে। ড্রাগনল্যান্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন মাও জে দং। সেই মাওয়ের জন্মদিনেই নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক বিমানটি প্রকাশ্যে আনেন তাঁর উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট তথা চেয়ারম্যান শি জিনপিং।
‘ইউরেশিয়ান টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু বিমান তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বেজিং। মাঝে ২০১৯ সালে এই প্রকল্পে আরও গতি আনার নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট শি। অত্যাধুনিক বিমানটিকে প্রকাশ্যে আনার পর এই নিয়ে সরকারি ভাবে অবশ্য কোনও বিবৃতি দেয়নি ড্রাগন সরকার।
চেয়ারম্যান মাওয়ের জন্মদিনে সিচুয়ান প্রদেশের চেংডুতে ‘ঝুহাই এয়ার শো’র আয়োজন করে চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএর বিমানবাহিনী। সেখানেই প্রথম বার আকাশে ওড়ে ষষ্ঠ প্রজন্মের ‘জে-৩৬’। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত লড়াকু বিমানে লেজের মতো একটি অংশ থাকে। ‘জে-৩৬’ জেটে সেটি রাখেননি বেজিংয়ের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
অত্যাধুনিক চিনা যুদ্ধবিমানটি তিন ইঞ্জিন বিশিষ্ট হওয়ায় পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু উড়ানগুলির থেকে এর গতিবেশ অনেকটাই বেশি। সূত্রের খবর, ‘জে-৩৬’ জেটে রয়েছে টার্বোফ্যান ইঞ্জিন। লেজের মতো অংশ না-থাকায় কোনও ভাবেই একে চিহ্নিত করতে পারবে না রাডার। অর্থাৎ, যুদ্ধবিমানের ‘স্টেলথ’ শক্তি বাড়িয়েছে বেজিং।
এ ছাড়া, এক বার জ্বালানি ভরে দীর্ঘ সময় আকাশে থাকতে পারবে ‘জে-৩৬’। পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু বিমানগুলির তুলনায় এর হাতিয়ার বহন করার ক্ষমতাও বেশি। আবার প্রয়োজনে মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরতে পারবেন ‘জে-৩৬’ জেটের পাইলট। শূন্যে কসরত দেখানোর ক্ষেত্রেও এর দক্ষতা আমেরিকা বা রাশিয়ার অতি শক্তিশালী যুদ্ধবিমানগুলির থেকে কোনও অংশ কম নয়।
‘জে-৩৬’ লড়াকু বিমানের নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘চেংডু এয়ারক্রাফ্ট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ’। এটি চিনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। ড্রাগনের এ হেন শক্তিবৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্র যে হাত গুটিয়ে বসে আছে, তা ভাবা ভুল। ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির কাছাকাছি পৌছে গিয়েছে লকহিড মার্টিন। প্রকল্পটির নাম ‘নেকক্স জেনারেশন এয়ার ডমিন্যান্স’ (এনজিএডি) রেখেছে আমেরিকা।
এ প্রসঙ্গে ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’-এর কাছে মুখ খুলেছেন আমেরিকার বায়ুসেনার আর এক পদস্থ আধিকারিক অ্যান্ড্রু হান্টার। তিনি বলেন, ‘‘ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট তৈরির ক্ষেত্রে হয়তো চিন আমাদের হারিয়ে দেবে। কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্রও পিছিয়ে নেই। সমস্যাটা সংখ্যার। যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে বেজিং। আর সেখানেই মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’’
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ঝুহাই এয়ারশোয়ে পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান ‘জে-৩৫এ’ ওড়ায় পিএলএ। এই শোয়ের মাধ্যমে প্রথম বার যুদ্ধবিমানটিকে সর্বসমক্ষে আনে বেজিং। লড়াকু জেটটির আকৃতির সঙ্গে আমেরিকার তৈরি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যথেষ্ট মিল রয়েছে।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, লকহিড মার্টিনের তৈরি ‘এফ ৩৫’ নকল করেই ‘জে-৩৫এ’ বানিয়েছে বেজিং। গত এক বছর ধরে চলা পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে আমেরিকার এই লড়াকু বিমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এর সাহায্যেই ইরানে ঢুকে হামলা চালিয়েছে ইহুদি ফৌজ।
উইকার্ট জানিয়েছেন, তাইওয়ান দখল করতে এডওয়ার্ড বিমানঘাঁটিকে নিশানা করতে পারেন চেয়ারম্যান শি। আর তাই পরবর্তী প্রজন্মের ‘বি-২১ রাইডার’ বোমারু বিমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে ওয়াশিংটন। থার্মোপরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম এই যুদ্ধবিমানগুলি ভবিষ্যতে ‘বি-১ ল্যান্সারের’ জায়গা নেবে বলে স্পষ্ট করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা অফিসার।
এর পাশাপাশি চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উইকার্ট। এতে আমেরিকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অনেক গোপন তথ্য বেজিংয়ের হাতে চলে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) সেপ্টেম্বর মাসে চিনা গুপ্তচরদের একটি হ্যাকিং মডিউলকে নষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় তদন্তকারী সংস্থা এফবিআই। গোয়েন্দা রিপোর্টে ওই হ্যাকিং মডিউলের নাম ‘ফ্যাক্স টাইফুন’ বলে উল্লেখ করা হয়। তথ্য চুরি করতে ক্যামেরা, ভিডিয়ো রেকর্ডার এবং দু’লক্ষের বেশি ম্যালঅয়্যার ব্যবহার করেছিলেন চিনা গুপ্তচরেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।