হাতে গিটার। মাথা ঠেকিয়ে রয়েছেন মঞ্চে। অর্পণ করছেন নিজেকে সঙ্গীতের ‘মন্দিরে’। যে শ্রোতারা তাঁকে এত ভালবাসা দেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন। ফেসবুকের ‘ডিসপ্লে পিকচার’-এ রয়েছে এই ছবি। গায়ক হওয়ার পাশাপাশি, ‘মাটির মানুষ’ হিসাবে অনুরাগীদের ‘মনের মানুষ’ হয়ে উঠেছেন অরিজিৎ সিংহ।
মঙ্গলবার শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে কনসার্ট করলেন অরিজিৎ সিংহ। দেশবিদেশের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠান করে কোটি কোটি টাকা পারিশ্রমিক পান গায়ক। উপার্জনের ক্ষেত্রেও বলিপাড়ার প্রথম সারির মধ্যে নিজের নাম লিখিয়েছেন অরিজিৎ। কিন্তু তাঁর জীবনে কোথায় সেই প্রাচুর্যের ছাপ?
বিলাসবহুল গাড়ি বা হেলিকপ্টারে নয়, বরং ট্রেনে চেপে আর পাঁচ জন মধ্যবিত্তের মতোই উত্তরবঙ্গে পৌঁছলেন অরিজিৎ। তার কারণ, তিনি অরিজিৎ সিংহ। শ্রোতাদের কাছের সেই ‘মাটির মানুষ’।
স্টেশনে তখন থিকথিক করছে ভিড়, অরিজিৎকে সামনে থেকে দেখার জন্য। মুখে হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে ভিড় পেরিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন তিনি। পিছনে পড়ে রইল অনুরাগীদের একরাশ মুগ্ধতা।
আনন্দবাজার অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, অরিজিৎ নাকি চার দেওয়ালের মধ্যেও মধ্যবিত্তদের মতোই জীবনযাপন করেন। তাঁর চিন্তাভাবনাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। শ্রীজাত জানিয়েছেন, এক বার ঘরের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র চালিয়েছিলেন বলে অরিজিৎ তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন।
শ্রীজাত বলেন, ‘‘আমি ঘরে এসি চালিয়েছিলাম। অরিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, এসি অফ করে ফ্যান চালাও। এসি চালালে কত খরচ হবে জান?’’ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের জন্য পরিবেশের কী ভাবে ক্ষতি হয়েছে তা-ও নাকি শ্রীজাতকে বলেছিলেন তিনি। অরিজিতের সারল্য এবং অতিসাধারণতায় মুগ্ধ তারকারাও।
অরিজিৎকে মাঝেমধ্যেই কর্মসূত্রে যেতে হয় মুম্বইয়ে। সেখানে একটি আবাসনে ফ্ল্যাটও কিনেছেন তিনি। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় অরিজিৎ সময় কাটান নিজের জন্মস্থান মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে।
জিয়াগঞ্জের অলিগলিতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অরিজিৎকে। রাস্তায় তাঁর কোনও অনুরাগীর সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে ছবিও তোলেন। কখনও আবার নিজের স্কুলের ভিতর ঢুকে পড়েন স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন। ‘শৈশবের’ সঙ্গে সময় কাটিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসেন তিনি।
মুম্বইয়ের নামকরা স্কুলে অরিজিৎ তাঁর পুত্রকে ভর্তি করাতে পারতেন। কিন্তু তিনি যে ‘সাধারণ’। তাই মুম্বইয়ের স্কুল ছেড়ে জিয়াগঞ্জের স্কুল বেছে নিয়েছেন তিনি। তাঁর পুত্রও যেন মাটির সংস্পর্শে থাকে, তাই হয়তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
নিজের পুত্রের জীবন প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিতে চাননি অরিজিৎ। অন্য অভিভাবকদের মতো স্কুলের বাইরে পুত্রের অপেক্ষায় সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে থাকেন গায়ক। পরনে টিশার্ট এবং পায়ে স্লিপার্স।
কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছেন, কিন্তু যাপনের ক্ষেত্রে বিলাসিতার ছাপ পাওয়া যায় না অরিজিতের জীবনে। নামী ব্র্যান্ডের পোশাক পরে সে ভাবে দেখাই যায় না অরিজিৎকে।
যাতায়াতের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করাও পছন্দ করেন না অরিজিৎ। স্কুটি চালিয়ে ঘুরতেই বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি। শোনা যায়, জিয়াগঞ্জের একটি স্কুলে অরিজিৎ ভোট দিতে এসেছিলেন স্কুটি চালিয়েই। পরনে ছিল সাধারণ পোশাক।
সপরিবারে যাতায়াত করার সুবিধার জন্য কোনও বিলাসবহুল গাড়ি নয়, বরং প্রয়োজনটুকু মেটাতে ছোট একটি গাড়ি কিনেছিলেন অরিজিৎ। মুম্বইয়ের রাস্তায় সেই গাড়ি নিয়েই ঘুরতেন তিনি।
কিন্তু কানাঘুষোয় শোনা যায় যে, পরে নাকি অরিজিৎ খানিকটা তাঁর ম্যানেজারের চাপেই বড় গাড়ি কেনেন। ম্যানেজার তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, অরিজিৎ সিংহের মতো শিল্পী এই ছোট গাড়ি থেকে নামলে সঙ্গীত পরিচালকেরা খুব বেশি পাত্তা দেবেন না।
সম্প্রতি আইপিএল-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গাইতে দেখা গিয়েছে অরিজিৎকে। সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক যখন মঞ্চে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং হার্দিক পান্ড্যকে ডেকে পরিচয়পর্ব সেরে ফেলছেন, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধোনির পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন অরিজিৎ। রোল উঠল দর্শকের আসনে।
১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অ্যাকোয়াটিকায় কনসার্টে এসেছিলেন অরিজিৎ সিংহ। টিকিটের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। তবু উপচে পড়েছিল ভিড়। শ্রোতাদের সঙ্গে ভিড়ে দাঁড়িয়ে অরিজিতের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন বাংলা ব্যান্ডের গায়ক রুপম ইসলামও। নেটমাধ্যমে সেই ভিডিয়ো মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে কলকাতার কনসার্ট শেষ হওয়ার পর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ওঠে। শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই সমাজমাধ্যমে জানান যে, নির্দিষ্ট ভেন্যু থেকে বহু দূরে তাঁদের গাড়ি পার্ক করতে হয়। কেউ কেউ আবার কর্তব্যরত কর্মীদের অভব্য আচরণের নিন্দা করেন। এই যাবতীয় অভিযোগের ভিত্তিতে অরিজিৎ তাঁর অনুরাগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন নেটমাধ্যমে। কারণ তিনি ‘মাটির মানুষ’ হয়েই শ্রোতাদের সমস্যা অনুভব করেছেন।
২০০৫ সালে ১৮ বছর বয়সে গানের একটি রিয়্যালিটি শোয়ে প্রতিযোগী হিসাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন অরিজিৎ। কিন্ত সেখান থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরতে পারেননি তিনি। তার পর কেটে গিয়েছে আরও আঠারো বছর। সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন, কিন্তু মানুষ হিসাবে এতটুকুও পাল্টাননি অরিজিৎ। বরং গান গেয়ে মানুষের আরও কাছে চলে এসেছেন সঙ্গীতজগতের এই মহাতারকা।
সকল ছবি সংগৃহীত।