প্রবল তুষারঝ়ড়ে বিপর্যস্ত পূর্ব ও মধ্য আমেরিকা। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, তুষারপাতের দাপটে বেসামাল জনজীবন। বিগত এক দশকের মধ্যে প্রকৃতির এমন ভয়াবহ রূপ দেখেনি আমেরিকাবাসী। ইতিমধ্যেই ‘স্টর্ম ব্লেয়ার’ নামের ভয়ঙ্কর তুষারঝড়ের বলি হয়েছেন আমেরিকার পাঁচ নাগরিক। প্রতি বছর শীতের মরসুমের শুরুতে বরফে ঢেকে যায় এই দেশের পূর্বাঞ্চলের বহু প্রদেশ।
যেখানেই চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। গাছপালা, রাস্তা, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো গাড়ি, সবই বরফে ঢাকা। পাল্লা দিয়ে চলছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। হাওয়া অফিসের সতর্কতা, তাপমাত্রা আরও নীচে নামবে।
আমেরিকার সাতটি প্রদেশ মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, কানসাস, মিসৌরি, কেনটাকি এবং আরকানসাসে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে প্রশাসন। গোটা এলাকা ঢেকেছে বরফের পুরু চাদরে। তাপমাত্রার পারদ রয়েছে হিমাঙ্কের অনেকটাই নীচে।
আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসে এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা ছিলই। সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। গত রবিবারের পর থেকেই অতি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে তুষারঝড়। প্রবল ঠান্ডা বাতাস বয়ে নিয়ে আসা মেরুঝড় আছড়ে পড়েছে পূর্ব ও মধ্য আমেরিকার প্রদেশগুলিতে। উত্তর মেরু থেকে সরাসরি বয়ে আসা এই তুষারঝড়ের প্রকোপে ঘরবন্দি ছ’কোটি মানুষ।
আমেরিকার একাংশ অন্তত এক সপ্তাহ বরফে মুড়ে থাকতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। সর্বত্র প্রায় একই ছবি। জনমানবহীন শুনশান রাস্তায় জমে পুরু বরফ। কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর বরফের থেকে এখনই আমেরিকাবাসীর মুক্তি নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর।
রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৩ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হয়েছে। নিকটবর্তী মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ায় ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হয়েছে। কানসাসের কিছু অংশে ৪৫ সেমি বরফ পড়েছে। ৩২ বছর আগে ঠিক এই রকম তুষারপাত প্রত্যক্ষ করেছিলেন কানসাসের বাসিন্দারা।উত্তর মিসৌরির কিছু অংশ ইতিমধ্যেই ৩৬ সেন্টিমিটার বরফের নীচে চলে গিয়েছে।
এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় সাধারণত যে ভাবে জন পরিষেবা ব্যাহত হয়, এ বারও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। তুষারঝড়ের দাপটে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎহীন বহু এলাকা। প্রবল তুষারঝড়ে বিধ্বস্ত উড়ান পরিষেবাও। তুষারঝড়ের দাপটে বাতিল হয়েছে প্রায় দেড় হাজার বিমান। ৮০০ বিমান দেরিতে চলছে। নাজেহাল যাত্রীরা।
যে ক’দিন এই ঝড়ের দাপট বজায় থাকবে, সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়বেন বলে জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছে প্রশাসন। চরম আবহাওয়ার কারণে সোমবার ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, ইন্ডিয়ানা এবং কেনটাকিতে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
একসঙ্গে একাধিক শীতপোশাক ছাড়া বাসিন্দাদের বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। হাতে গ্লাভস পরলেও তার নীচে মিটেনস পরার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। ‘ফ্রস্ট বাইট’ থেকে বাঁচতে গায়ে চাপাতে বলা হচ্ছে একাধিক ঢিলেঢালা পশমের কোট।
গত কয়েক দশকে এমন ঠান্ডা পড়েনি প্রদেশগুলিতে। তাই সতর্কতা হিসাবে বাসিন্দাদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ১৫ মিনিটের সময় বেশি বাইরে থাকলেই ফ্রস্ট বাইটের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন আবহ বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তুষারঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশগুলির অন্যতম কানসাস। সেখানে মেরুঝড়ের তাণ্ডব প্রাণ কেড়েছে কয়েক জনের। কানসাসের উইচিটাতে একটি এসইউভি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাঁধের নীচে পড়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় ২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বরফের মধ্যে গাড়ি আটকে এক ট্রাকচালক মারা গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।
ভার্জিনিয়ার ওয়েকফিল্ডে প্রবল গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এক ব্যক্তি মারা গিয়েছেন। কানসাসের পাশাপাশি ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি এবং ভার্জিনিয়া সহ বেশ কয়েকটি প্রদেশে কয়েকশো দুর্ঘটনা এবং আটকে পড়া গাড়ির চালকদের উদ্ধার করার খবর পাওয়া গিয়েছে।
কানসাসে শনিবার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ২০০টিরও বেশি ঝড় সম্পর্কিত সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গিয়েছে। সিনসিনাটি ও উত্তর কেনটাকি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রবিবার ২০ সেমি তুষারপাত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে।
কেনটাকি, ইন্ডিয়ানা, ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ইলিনয় এবং মিসৌরিতে সোমবার ভোরে বরফঢাকা গাছগুলি বিদ্যুতের তারের উপর পড়ে গিয়ে রাস্তা অবরুদ্ধ করে দেয়। এর ফলে বিভিন্ন প্রদেশের আড়াই লক্ষ বাসিন্দা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েন।
অতি শীতল বাতাসের মেরু ঘূর্ণি সাধারণত উত্তর মেরুতেই ঘুরপাক খায়। এর পর সেই ঘূর্ণি দক্ষিণের দিকে প্রসারিত হওয়ার জেরে প্রবল ঠান্ডার মুখে পড়ে আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে তুষারঝড়ের প্রাবল্য কমতে পারে বলে আশার বাণী শুনিয়েছেন আবহবিদেরা। তুষারঝড়ে আক্রান্ত প্রদেশগুলির প্রশাসনিক কর্তারা অবশ্য মনে করেছেন, যে পরিমাণ বরফ জমেছে তা সরাতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে।
সব ছবি: সংগৃহীত।