
যে দিকে দু’চোখ যায় সে দিকেই শুধু মাইলের পর মাইল ঊষর বাদামি বালি। দেখা মেলে না ছিটেফোঁটা বৃষ্টিরও। কড়া রোদ আর নোনা জল ছাড়া কিছুই মেলে না। চার দিকে শুধু ধু-ধু করা প্রান্তর। শুধু বালি আর বালি। দূরদূরান্তে তাকালেও মরুভূমির বুকে জলের হদিস পাওয়া দুষ্কর।

পৃথিবীর শুষ্ক স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম আরব মরুভূমি। আরব দেশের কথা মাথায় এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। আর সেই মরুভূমির বুক চিরে ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়া আরব বেদুইন। আরবের এই বিস্তীর্ণ মরুভূমিটি ২০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, কয়েক হাজার বছর আগে চরম আবহাওয়াযুক্ত এই অঞ্চলটিতেই ছিল শান্ত স্নিগ্ধ সবুজে ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ। গবেষকেরা জানিয়েছেন, বর্তমানে মরুভূমির মতো জলবায়ু থাকা সত্ত্বেও এখানে এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যাতে মনে করা যেতে পারে আরব এক সময় সবুজ এবং উর্বর ছিল।

জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ জাকি এবং অধ্যাপক সেবাস্তিয়ান ক্যাসেলটর্ট, সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল কাদের এম আফিফি এবং গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল পেট্রাগলিয়ার নেতৃত্বে একটি দল একটি গবেষণা চালিয়েছে। সেই গবেষণার ফলাফল ‘কমিউনিকেশন্স আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে’ প্রকাশিত হয়েছে।

মরুভূমিরটির অধিকাংশই পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ জলবায়ুর উদাহরণ হলেও অতীতে ঠিক বিপরীত ছিল আরবের আবহাওয়া। আরব উপদ্বীপের বিস্তীর্ণ মরুভূমির বেশির ভাগ অংশ এক সময় সবুজে ঢাকা ছিল। গবেষণায় একটি সুপ্রাচীন হ্রদ, নদী, প্রবাহিত জলের স্রোতের চিহ্ন সমেত এক দীর্ঘ উপত্যকা থাকার প্রমাণ মিলেছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। সেই গবেষণা থেকে ইঙ্গিত মেলে শুষ্ক মরু অঞ্চলে বর্তমানের থেকে অনেক বেশি বৃষ্টিপাতের সাক্ষী ছিল এই অঞ্চলটি।

আরবের খালি কোয়ার্টার বা রুব আল-খালি। বিশ্বের বৃহত্তম মরুভূমিগুলির মধ্যে একটি। সেখানে একটি বিশাল হ্রদ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বালির নীচে হ্রদের পলির আস্তরণ খুঁজে বার করেছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞেরা। এই পলির উপস্থিতি প্রমাণ করে কয়েক হাজার বছর আগের একটি হ্রদের অস্তিত্বের কথা।

উপগ্রহচিত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও মাটির নীচে থাকা পলি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই হ্রদটির যে সময়ে অস্তিত্ব ছিল সেই সময়ে ওই অঞ্চলটি সবুজে মোড়া ছিল। ব্যাপক বৃষ্টি নামত অধুনা ঊষর মরুর বুকে।

সুপ্রাচীন হ্রদটি ছিল ১ হাজার ১০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং প্রায় ৪২ মিটার গভীর। এর আয়তন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ মিশিগান-হুরন হ্রদের প্রায় সমান ছিল। অধ্যাপক ক্যাসেলটর্ট বলেছেন, ‘‘ওই সময় এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার কারণে হ্রদটির আকার এত বড় হয়ে উঠেছিল যে, এর জল উপচে পড়ে।’’

সেই জল এতটাই বেশি হয়ে গিয়েছিল যে, জলের চাপে হ্রদটি ভেঙে যায় এবং ওই অঞ্চলে একটি ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। সেই বিধ্বংসী বন্যার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, এর ফলে ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি উপত্যকা ভেঙে যায়। হ্রদের আশপাশের নমুনার রেডিয়ো কার্বন ডেটিংয়ের ফলে এই হ্রদের বয়স জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।

একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, হ্রদ ছাড়াও ১১ হাজার বছর আগে আরবে ছিল নদী। ছিল সাভানা। বিজ্ঞানীদের অনুমান, সেই সময়কার জলবায়ু ছিল আর্দ্র। বৃষ্টিপাতের ফলে স্বাভাবিক ভাবে জন্মাত যথেষ্ট গাছপালাও। এই সময়কে ‘সবুজ আরব’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

আরব উপদ্বীপ যে তেলের বিশাল ভান্ডার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খনিজ তেলের প্রাথমিক উৎস হল নদী, হ্রদ বা সমুদ্রের তলদেশে জমা হওয়া মৃত শৈবাল ও উদ্ভিদের অবশেষ। অক্সিজেনের অভাবে মৃত অণুজীবগুলো হাইড্রোকার্বনে পরিণত হয়েছে।

মাটির নীচে এই ধরনের তেলের ভান্ডার মজুত থাকার অর্থ হল, কয়েক হাজার বছর ধরে আরব আজকের মতো শুষ্ক অনুর্বর ভূমি ছিল না। বরং হ্রদ এবং নদী অববাহিকার অস্তিত্ব ছিল সেখানে। আর এই অঞ্চলে বিচরণ করত বহু প্রাণী।

অতীতের আরব ছিল আর্দ্র। সেখানে পূর্ব আফ্রিকার সাভানার মতো পরিবেশ ছিল।

গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মাইকেল পেট্রাগলিয়া বলেন, ‘‘হ্রদ এবং নদীর ভূ-দৃশ্যের গঠন, তৃণভূমি এবং সাভানার পরিবেশ থাকায় আজকের শুষ্ক এবং অনুর্বর মরুভূমিতে ছিল মানুষের বাস। শিকারের সুবিধা ও তৃণভূমির প্রাচুর্যের জন্য আফ্রিকা থেকে বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে এই অঞ্চলে।’’

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সেই সময়ে সেখানে বসবাসকারী মানুষের ওপর এর বড় প্রভাব পড়েছিল। হ্রদ, নদী ও বিভিন্ন সবুজ তৃণভূমির এমন পরিবেশে আকৃষ্ট হন শিকারি, পশুপালক ও আদিম পর্বের কৃষকেরা। এমন পরিবেশ বেঁচে থাকার পাশাপাশি আরও সহজে অন্যান্য অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ ছিল এই সব যাযাবর গোষ্ঠীর।

১১ হাজার থেকে ৬ হাজার বছর আগে পর্যন্ত আরবের আর্দ্র আবহাওয়ার শেষ পর্যায়টি ছিল বলে ধারণা করা হয়। গবেষকদের অনুমান, প্রায় ৬ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যায়। এলাকাটি শুষ্ক হয়ে ওঠে এবং জলের অভাবে এখানকার বাসিন্দারা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। গবেষকেরা বলছেন, বৃষ্টিপাতের অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন নাটকীয় ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং অনেক যাযাবর গোষ্ঠী এই নতুন ও কঠোর মরুভূমির অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক কালে আবারও সবুজ হয়ে উঠতে শুরু করেছে আরবের মরুভূমি। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনই এর প্রধান কারণ।
সব ছবি: সংগৃহীত।