
অশান্ত কাশ্মীর সীমান্ত। বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার রাতেও সেখানে গোলাগুলি চালিয়েছে পাকিস্তান। অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে রাতভর গুলি চালায় পাক সেনা। ভারতীয় সেনাঘাঁটিগুলি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারতও।

অভিযোগ, ভারতীয় সেনাকে লড়াইয়ে প্ররোচিত করতে ছোটখাটো সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। নিয়ন্ত্রণরেখায় বড় কোনও হামলা এখনও তারা করেনি। তবে অনবরত গুলি চলতে থাকায় রাতভর ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে জওয়ানদের। তাঁরাও পাল্টা গুলি ছুড়ে জবাব দিচ্ছেন।

এই নিয়ে পর পর দুই রাতে পাকিস্তানের তরফ থেকে নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করা হল। বৃহস্পতিবার রাতেও একই ভাবে তারা ভারতীয় সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল।

দিন কয়েক আগে হিন্দুদের নাম করে বিষোদ্গার করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। তার তিন-চার দিনের মাথায় জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালায় ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ বা টিআরএফ। তার পর আবার গত দু’দিন ধরে নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘর্ষবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন। ঘটনাপ্রবাহ দেখে বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাইছে পাকিস্তান।

কিন্তু সত্যিই কি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে পাকিস্তানের? কোমর ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি নিয়ে কি তারা লড়াই করতে পারবে ভারতের সঙ্গে?

অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই জর্জরিত। এর পর এখন সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়া এবং পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ (পিএসএক্স)-এর মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ার কারণে পাক অর্থনীতির হাল আরও বেহাল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এই সময় ভারতের সঙ্গে সংঘাতে গেলে ফল মোটেও ভাল হবে না পাকিস্তানের জন্য। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

পহেলগাঁও কাণ্ডের পর সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা, অটারী-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করা, পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল-সহ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে করা ভারত সরকারের একাধিক পদক্ষেপের পর বৃহস্পতিবার রক্তক্ষরণ হয় পিএসএক্সে। সে দেশের শেয়ার বাজারের সূচক দু’হাজার পয়েন্ট পড়ে যায়। সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিতে হয় বাজার। শেয়ার বাজারের সেই ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পাকিস্তান।

বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ভারত সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি বাতিল করার প্রভাব মারাত্মক ভাবে পড়েছে পাকিস্তানের শেয়ার বাজারের উপর। শুক্রবারও ২ শতাংশ নেমে যায় শেয়ার সূচক। এর মধ্যে কৃষিভিত্তিক সংস্থাগুলির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

বিশেষজ্ঞেরা এ-ও সতর্ক করেছেন, ভারতের তরফে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি বাতিল করার ফল ভুগতে পারে পাকিস্তানের কৃষিব্যবস্থা। গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে।

বস্তুত, ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলে নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি অনুসারে, সিন্ধু এবং তার দুই উপনদী, বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জলের উপরে অধিকার ও কর্তৃত্ব থাকবে পাকিস্তানের। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে সিন্ধুর তিন উপনদী— বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সাতলেজ়) এবং ইরাবতী (রাভি)।

সামগ্রিক ভাবে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলির মোট জলের উপর পাকিস্তানের অধিকার ৮০ শতাংশ এবং ভারতের মাত্র ২০ শতাংশ। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই জল ব্যবহার করলেও কোনও অবস্থাতেই জলপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না।

কিন্তু সেই সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করতেই দৃশ্যত মাথায় হাত পড়েছে পাকিস্তানের। এর ফলে পাকিস্তানের পঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে জলসেচ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। যার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষিতে। অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হতে পারে। কারণ, সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির জলের উপরেই পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষি নির্ভরশীল!

পাকিস্তানের ২০২২-২৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, সে দেশটির জিডিপিতে ২২.৭% অবদান কৃষির। ফলে ইতিমধ্যেই কোমর নুইয়ে পড়া পাক অর্থনীতি আরও চাপের সম্মুখীন হতে পারে।

তবে এ তো গেল বর্তমান পরিস্থিতি। এর আগেও কি অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল যাচ্ছিল পাকিস্তানের? উত্তর, না। গত বছর প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তান।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভাঙনের মুখে থাকা সরকার, খারাপ শাসনব্যবস্থা, সামরিক একনায়কতন্ত্র এবং সীমান্ত সন্ত্রাসের কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি ধুঁকছিল। ফুরিয়ে এসেছিল তহবিল। বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারও তলানিতে পৌঁছেছিল।

এর পর অর্থনীতি বাঁচাতে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফের কাছে হাত পাতে ইসলামাবাদ। আইএমএফ প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে তাদের থেকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছিল পাকিস্তান।

এ ছাড়াও বালোচ বিদ্রোহীদের দৌরাত্ম্য এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণেও জর্জরিত পাকিস্তান। সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকেরাও অনেক দিন ধরে রোষ পুষে রেখেছেন সরকারের বিরুদ্ধে। দিকে দিকে প্রতিবাদ চলছে ইমরানের মুক্তির দাবিতে।

অন্য দিকে, বুধবার আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) আর্থিক ঝুঁকি এবং অব্যাহত বহিরাগত দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের ২০২৫ সালের জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস ২.৬ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের জি়ডিপি নিয়ে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এডিবি)-ও।

তাই অর্থনৈতিক জট, অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং কৃষি ব্যবস্থা বাঁচাতে বাঁচাতে পাকিস্তান কতটা ভারতের সঙ্গে পেরে উঠবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞেরা।

সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হলে আরও এক বার লজ্জার হার দেখতে হতে পারে পাকিস্তানকে। এমনকি, অর্থনীতির কোমরও ভেঙে যেতে পারে। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।