দেখতে দেখতে বছর পার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১ বছর হয়ে গেল। তবুও যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষ্মণই নেই। যুদ্ধে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর ছারখার হয়ে গিয়েছে। তবুও পরাক্রমী রাশিয়ার আগ্রাসনের কাছে কোনও ভাবেই মাথা নোয়ায়নি ইউক্রেন। বরং ভ্লাদামির পুতিনের সৈন্যদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে ইউক্রেনের যোদ্ধারা। এর নেপথ্যে রয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। রাশিয়ার তুলনায় অনেক ছোট দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও যে ভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন তিনি, তা নজর কেড়েছে আন্তর্জাতিক মহলের। এই ১ বছরে বরাবর চর্চায় থেকেছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ছবি সংগৃহীত।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের মাটিতে প্রথম বার হামলা চালিয়েছিল মস্কো। তার পর থেকেই চর্চায় থেকেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ধারে-ভারে-বহরে ইউক্রেনের তুলনায় অনেকটাই শক্তিশালী পুতিনের বাহিনী। তবুও দমে যাননি জেলেনস্কি। বরং ঠান্ডা মাথায় প্রতিনিয়ত দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ছবি সংগৃহীত।
রাজনীতি, দেশ চালানোর বাইরে ব্যক্তি জেলেনস্কির চরিত্র বেশ বর্ণময়। জীবনের শুরুতে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনও সংযোগই ছিল না। বরং সৃজনশীল দুনিয়াই তাঁকে টেনেছিল। পেশা হিসাবে অভিনয়কে বেছে নিয়েছিলেন। হয়েছিলেন রুপোলি পর্দার নায়ক। নায়ক থেকে কী ভাবে নেতা হলেন জেলেনস্কি?
ছবি সংগৃহীত।
১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম জেলেনস্কির। ইউক্রেনে ইহুদি পরিবারে জন্ম। মধ্য ইউক্রেনের ক্রিভি রিহ শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর বাবা অলেকজ়ান্ডার জেলেনস্কি পেশায় অধ্যাপক এবং কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট। তাঁর মা রিমা জেলেনস্কা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার।
ছবি সংগৃহীত।
রাশিয়ান ভাষাতেই কথা বলতেন জেলেনস্কি। ১৬ বছর বয়সে বিদেশি ভাষা হিসাবে ইংরেজি পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন তিনি। ইজ়রায়েলে পড়াশোনার জন্য বিশেষ অনুদানও পান। কিন্তু সেখানে জেলেনস্কিকে যেতে দেননি তাঁর বাবা।
ছবি সংগৃহীত।
এর পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন জেলেনস্কি। কিভ ন্যাশনাল ইকোনমিক ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন জেলেনস্কি। আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও এ নিয়ে এগোননি তিনি।
ছবি সংগৃহীত।
আইনের ছাত্র বরং পেশা হিসাবে অভিনয়কে বেছে নেন। ঝোঁকেন বিনোদন দুনিয়ার দিকে। তাঁর যখন ১৭ বছর বয়স, সেই সময় কেভিএন কমেডি প্রতিযোগিতায় স্থানীয় দলের হয়ে যোগ দেন। এর পর কমেডি অভিনেতা হিসাবে নিজের প্রতিভা তুলে ধরেন জনমানসে।
ছবি সংগৃহীত।
১৯৯৭ সালে ‘ভার্তাল ৯৫’ নামে কমেডি দল তৈরি করেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় ওই কমেডি দলের শোয়ের আয়োজন করা হয়। ২০০৩ সালে ওই দল ইউক্রেনের টিভি চ্যানেলের জন্য বিভিন্ন শো প্রযোজনার কাজে হাত দেয়।
ছবি সংগৃহীত।
একাধিক টিভি শোয়ে অংশ নেন জেলেনস্কি। বাড়তে থাকে তাঁর জনপ্রিয়তা। টিভিতে অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিতেও অভিনয়ের সুযোগ পান সুদর্শন চেহারার জেলেনস্কি।
ছবি সংগৃহীত।
২০০৮ সালে প্রথম বার রুপোলি পর্দার দুনিয়ায় পা রাখেন জেলেনস্কি। ‘লভ ইন দ্য বিগ সিটি’ ছবির হাত ধরে অভিনেতা হিসাবে আরও পরিচিতি পান তিনি। এই ছবির সিক্যুয়েল ‘লভ ইন দ্য বিগ সিটি ২’ এবং ‘লভ ইন দ্য বিগ সিটি ৩’তেও ছবিতেও দেখা যায় জেলেনস্কিকে।
ছবি সংগৃহীত।
অভিনেতা হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জনের পর একাধিক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেতে থাকেন জেলেনস্কি। তাঁর অন্যান্য ছবিগুলি হল, ‘অফিস রোম্যান্স আওয়ার টাইম’, ‘৮ ফার্স্ট ডেটস’।
ছবি সংগৃহীত।
অভিনেতা হিসাবে নিজেকে ক্রমশ মেলে ধরছিলেন জেলেনস্কি। এর মধ্যেই ২০১৫ সালে ‘সার্ভেন্ট অফ দ্য পিপল’ নামে একটি টিভি সিরিজ়ে অভিনয়ের প্রস্তাব পান তিনি। ওই সিরিজ়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কী আশ্চর্য! যে চরিত্রে এক দিন অভিনয় করতে হয়েছিল, সেই প্রেসিডেন্টের কুর্সিতেই যে তাঁকে ভবিষ্যতে বসতে হবে, তা বোধহয় কখনও ভাবেনইনি। একেই হয়তো বলে ‘বিধাতার লিখন!’
ছবি সংগৃহীত।
রাশিয়ান ভাষাতেই অধিকাংশ কাজ করেছেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনীয় ভাষায় তাঁর প্রথম কাজ ছিল রোম্যান্টিক কমেডি ‘আই ইউ হি সি’।
ছবি সংগৃহীত।
অভিনয় করতে করতেই নিজের সংসার গোছান জেলেনস্কি। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওলেনা কিয়াশকোর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন শুরু হয় তাঁর। স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই তাঁদের আলাপ। জেলেনস্কির প্রযোজনা সংস্থায় চিত্রনাট্যকার হিসাবে কাজ করেছিলেন ওলেনা। বর্তমানে পেশায় তিনি স্থপতি। জেলেনস্কি এবং ওলেনার এক কন্যা এবং পুত্র সন্তান রয়েছে।
ছবি সংগৃহীত।
অভিনেতা হিসাবে পথ চলতে চলতে আচমকাই রাজনীতির আঙিনায় ঢুকে পড়লেন জেলেনস্কি। সাল ২০১৮। মার্চ মাস। সেই সময় জেলেনস্কির প্রযোজনা সংস্থা ‘ভার্তাল ৯৫’ একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয় ‘সার্ভেন্ট অফ দ্য পিপল’। এই নামেই টিভি সিরিজ়ে অভিনয় করেছিলেন জেলেনস্কি।
ছবি সংগৃহীত।
তবে রাজনীতিতে পা রাখার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না জেলেনস্কির। কিন্তু সেই সময় থেকেই জল্পনা ছড়ায় যে, দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে শামিল হতে পারেন জেলেনস্কি। এই জল্পনার আবহে সে বছরের ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচনের ঠিক ৪ মাস আগে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে নিজের নাম ঘোষণা করেন জেলেনস্কি।
ছবি সংগৃহীত।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেমন আওয়াজ তোলেন, তেমনই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়েও সরব হন জেলেনস্কি। তবে সেই সময় সংবাদমাধ্যমের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল ইউক্রেনের ২০টি সংবাদমাধ্যম জেলেনস্কিকে বার্তা দিয়ে জানায়, ‘‘সাংবাদিকদের এড়ানো বন্ধ করুন।’’ প্রত্যুত্তরে সেই সময় জেলেনস্কি বলেছিলেন যে, তিনি সাংবাদিকদের এড়াচ্ছেন না। বিভিন্ন টক শোয়ে মুখ দেখিয়ে জনসংযোগ করতে চান না বলে জানান।
ছবি সংগৃহীত।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ড হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ। প্রথম রাউন্ডেই বাজিমাত করেছিলেন জেলেনস্কি। এর পর সে বছরের ২১ এপ্রিল নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ডে ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এর পরই প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন।
ছবি সংগৃহীত।
ইউক্রেনের প্রথম ইহুদি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। এ এক আস্ত সিনেমাই বটে। টিভির পর্দায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এক দিন সত্যি সত্যিই প্রেসিডেন্টই হলেন জেলেনস্কি।
ছবি সংগৃহীত।
তবে রিল লাইফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার থেকে রিয়েল লাইফের প্রেসিডেন্ট হওয়া মুখের নয়! কারণ এটা জ্বলন্ত বাস্তব। এ ক্ষেত্রে কোনও চিত্রনাট্য নেই। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দু’বছরের মাথাতেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হল জেলেনস্কিকে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যে লড়াই এখনও চলছে। এক দিকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ, অন্য দিকে এই দুর্দিনে দেশের মানুষকে উদ্ধার করা— এই দুই লড়াই লড়ছেন জেলেনস্কি।
ছবি সংগৃহীত।