
বুলডোজ়ারের ঘায়ে উজাড় একের পর এক গাছ। বাস্তুহারা হয়ে প়ড়ছে সেখানকার স্থায়ী ‘বাসিন্দা’রা। সবুজ অরণ্য ধ্বংস করে নাগরিক জীবনের উন্নয়নের স্বার্থে হায়দরাবাদের জঙ্গলে শুরু হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। ময়ূরের কান্না, পাখিদের ডানা ঝাপটানো, বাস্তুহারা সাপদের দিকে না তাকিয়েই চলছে ‘উন্নয়ন’।

হায়দরাবাদের ফুসফুস উপড়ে তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক করার পরিকল্পনা করেছে রেবন্ত রেড্ডি সরকার। কাঞ্চি গাচ্চিবওলির ৪০০ একর জমি সাফ করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। কয়েক একর জমি ইতিমধ্যেই খালি করা হয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে সরকার এই জমি নিলামে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। কয়েক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জমি দখল নিয়ে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছিলেন পড়ুয়ারা। পুলিশের সঙ্গে পড়ুয়াদের সংঘাতের জেরে উত্তপ্ত হয় হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর ক্যাম্পাসের ভিতরে ও বাইরে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।

৪০০ একরের অরণ্যভূমির উপরে বুলডোজ়ার চালিয়ে সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক গড়ার সরকারি প্রচেষ্টা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা। জমি অধিগ্রহণ করে বেসরকারি সংস্থার কাছে নিলামে চড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হয়। ওঠে গো-ব্যাক স্লোগানও।

বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে গাছ কেটে ফেলার ধু-ধু করা জমির ছবি ও ভিডিয়ো। ময়ূরের আর্তনাদ, ঘরছাড়া হরিণ, শয়ে শয়ে পাখি, মৃত হরিণশাবককে পড়ে থাকতে দেখে শিউরে উঠছে মানুষ। বন ও বন্যপ্রাণ ধ্বংসের সেই ছবি নজর এড়ায়নি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের। নড়েচ়ড়ে বসেছে সুপ্রিম কোর্ট। সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ জারি করেছে শীর্ষ আদালত। এর আগে তেলঙ্গানা হাইকোর্টও গাছ কাটা এবং জমি দখলে স্থগিতাদেশ জারি করেছিল।

বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে এই বনাঞ্চলে কোনও রকম গাছ কাটা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। বিচারপতি বি আর গবই এবং এজি মসীহের বেঞ্চ গাছের সুরক্ষা দেওয়া ছাড়া সেখানে যে কোনও ধরনের সরকারি কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তেলঙ্গানার কংগ্রেস সরকারকে এই ৪০০ একর জমিতে যাবতীয় কার্যকলাপ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।

বৃহস্পতিবার আদালত গাছ কাটার উপর অন্তর্বর্তিকালীন স্থগিতাদেশের আদেশ দেয় এবং তেলঙ্গানা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রারকে (বিচার বিভাগ) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রিপোর্ট পেশ করতে বলে। আদালতের রায়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে বিক্ষোভকারী পড়ুয়া ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের।

১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ করা হয়েছিল ২,৩০০ একর জমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি বরাদ্দ হলেও আইনত রাজ্য সরকারই ছিল সেই সমগ্র জমির মালিক। বছরের পর বছর ধরে সরকার এই ২,৩০০ একর থেকে কিছু কিছু জমি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বরাদ্দ করেছে। হয়েছে একটি বাস ডিপো, একটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, একটি তথ্যপ্রযুক্তি ক্যাম্পাস, গাচ্চিবওলি স্পোর্টস স্টেডিয়াম, একটি শুটিং রেঞ্জ ইত্যাদি।

২০০৩ সালে তৎকালীন সংযুক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার বিতর্কিত ৪০০ একর জমি ‘আইএমজি ভারত’ নামের একটি বেসরকারি ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা সংস্থার হাতে তুলে দেয়।

সরকারের সঙ্গে সেই সংস্থা চুক্তি করে একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরি করবে বলে। আইএমজি ভারত দাবি করেছিল, তারা আমেরিকার একটি সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন। ২০০৫ সালে প্রকাশ্যে আসে এই সংস্থার জালিয়াতির কথা। বন্ধ হয়ে যায় সেই প্রকল্প। ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় এই ৪০০ একর জমি তেলঙ্গানা সরকারের মালিকানাধীন।

বিতর্কিত এই জমিতে ৭০০টিরও বেশি প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে হাজার হাজার গাছ রয়েছে যেগুলি শহরের ফুসফুস হিসাবে কাজ করে। পরিযায়ী পাখি-সহ প্রায় ২৩৭ প্রজাতির পাখির আশ্রয়স্থল গাছগুলি। বন্যপ্রাণীদের মধ্যে হরিণ, বুনো শুয়োর, কাছিম, বহু সরীসৃপ এবং সাপের আবাসস্থল।

রয়েছে দু’টি হ্রদ— ‘পিকক লেক’ এবং ‘বাফেলো লেক’। এই হ্রদ দু’টি এখানকার বাসিন্দাদের জলের উৎস ও শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের আগমনের অন্যতম কারণ।

রেড্ডির সরকার অবশ্য আন্দোলনকারীদের কথা মানতে রাজি নয়। তেলঙ্গানা সরকার পাল্টা যুক্তি দিয়ে জানায়, হায়দরাবাদের অনেক জায়গাতেই সাপ, ময়ূর রয়েছে। কিন্তু সব জায়গাকে বনাঞ্চল বলা যায় না। সরকারের এই যুক্তিকে অবশ্য নস্যাৎ করে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। তেলঙ্গানা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার (বিচার বিভাগ) যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, সেটি উদ্ধৃত করে বিচারপতিরা জানিয়েছেন, প্রতিবেদন এবং ছবিগুলি দেখে সেখানকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলেই মনে হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক গাছ কাটা হচ্ছে এবং বিশাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আদালত উল্লেখ করেছে।

আদালত আরও জোর দিয়ে বলেছে যে, প্রতিবেদনে ময়ূরের মতো পাখি এবং হরিণ-সহ বন্যপ্রাণীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলি প্রাথমিক ভাবে ইঙ্গিত দেয় যে সেখানে বন্যপ্রাণীদের বসবাস রয়েছে।

নিলামের আগে বনভূমি পরিষ্কার করার জন্য ৩০ মার্চ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কমপক্ষে ৫০ জনকে পাঠায়। ছাত্রদের দমিয়ে রাখতে ক্যাম্পাসটি ব্যারিকেড করা হয়েছিল। এর ফলে ক্যাম্পাসে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ৫৩ জন পড়ুয়াকে আটক করা হয়। দু’জনকে গ্রেফতার করে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়। বেশ কয়েক জন আহত হন। ছাত্র ইউনিয়ন অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করে।

সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটিকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তেলঙ্গানা হাই কোর্ট পরবর্তী শুনানি ৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর।

সরকার বলছে, জমি নিলাম করলে কেবল সরকারি কোষাগারই ভরবে না, বরং ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য বিনিয়োগও আসবে। ৫ লক্ষেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, কাঞ্চি গাচ্চিবওলির আইটি করিডর হায়দরাবাদের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এলাকাগুলির মধ্যে একটি। এখানে সম্পত্তির দাম অত্যন্ত বেশি।
সব ছবি: সংগৃহীত।