ছবি মুক্তির আগে তেমন কোনও প্রচার নেই। কোনও সাক্ষাৎকারও দেননি শাহরুখ খান। অনুরাগীদের সঙ্গে, দর্শকের সঙ্গে ‘জওয়ান’ মুক্তির আগে অভিনেতার যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে এক্স (সাবেকি টুইটার) হ্যান্ডলের ‘#আস্কএসআরকে’ সেশনগুলি। কিন্তু তাঁর ছবির খাঁজে খাঁজে যে অন্য ছবির সূত্র রয়েছে, উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন দুর্ঘটনার— সে সব নিয়ে নীরব কেন বলিউডের ‘বাদশা’? ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা, গোরক্ষপুর হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনা থেকে শুরু করে ‘জওয়ান’কে ছুঁয়ে গিয়েছে ‘স্বদেশ’, ‘কিল বিল’, ‘শোলে’র মতো ছবি। বাদ পড়েনি বিদেশি ওয়েব সিরিজ়ও। আড়ালে আবডালে নিজের ছবির মাধ্যমে কি কোথাও খোঁচাও দিয়ে ফেললেন শাহরুখ?
আজাদ না কি বিক্রম রাঠৌর— ‘জওয়ান’-এ তার পরিচয় আদতে কী? চার বছরের বিরতি নিয়ে আবার বড় পর্দায় ফিরলেন শাহরুখ। ছবির অন্তিম পর্বে দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তাও দিলেন তিনি। বোঝালেন ‘আঙুলের’ ক্ষমতা (আড়ালে তার ব্যর্থতাও)। সরকার নির্বাচনের সময় কী কী প্রশ্নচিহ্ন তোলা প্রয়োজন, তা চোখে চোখ রেখে বললেন। সিনেমার সংলাপ ভেবে দর্শক তা ঢোঁক গিলে হজমও করলেন। কিন্তু ছবি দেখার সময়, শাহরুখ খান-নয়নতারা-বিজয় সেতুপতি-দীপিকা পাড়ুকোনের অভিনয়ের ফাঁকে যা রইল, তা দর্শকের মনে ধরা পড়ল কি?
বৃহস্পতিবার প্রেক্ষাগৃহে ‘প্যান ইন্ডিয়ান’ ছবি ‘জওয়ান’ মুক্তির পর বলিপাড়ার একাংশ দাবি করেছিলেন, এ ছবি নাকি নকল করা। আবার অনেকে এই দাবি হাওয়ায় উড়িয়েছেন। কিন্তু ‘জওয়ান’-এ যে অন্য ছবির কিছু প্রসঙ্গ বা ‘রেফারেন্স’ রয়েছে তা-ও সুস্পষ্ট। শাহরুখের ব্যক্তিগত জীবনের আঁচও পড়েছে ছবিতে।
‘জওয়ান’-এ বেশ কিছু দৃশ্যে ব্যান্ডেজ জড়ানো ‘লুক’-এ দেখা যায় শাহরুখকে। মার্ভেল সুপারহিরোর জগতে মুন নাইট নামের একটি চরিত্র রয়েছে। তার চোখটুকু ছাড়া বাকি শরীর সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া। ‘জওয়ান’-এর সূচনাপর্বে শাহরুখকে সারা শরীরে ব্যান্ডেজ জড়ানো অবস্থায় দেখে মার্ভেল অনুরাগীরা মুন নাইটের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতেই পারেন।
‘জওয়ান’-এ নিজের ছবিরই ছাপ ফেলেছেন শাহরুখ। ২০০৪ সালে আশুতোষ গোয়ারিকরের পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল ‘স্বদেশ’। শাহরুখ অভিনীত এই ছবি প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। ‘স্বদেশ’ ছবির ছাপই ধরা পড়েছে ‘জওয়ান’-এ।
‘স্বদেশ’ ছবিতে শাহরুখের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কিশোরী বল্লাল। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল কাবেরী আম্মা। যদিও ছবিতে শাহরুখের গর্ভধারিণী মা ছিল না সে। ‘জওয়ান’ ছবিতেও কাবেরী আম্মা নামের একটি চরিত্র রয়েছে। ‘স্বদেশ’-এর মতোই ‘জওয়ান’-এ কাবেরীর চরিত্র একই সুতোয় বোনা হয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুবন্দোবস্তের অভাবে মারণ রোগ এনসেফাল্যাইটিসে মৃত্যু হল ৬০ জন শিশুর। ‘জওয়ান’-এর এই দৃশ্য দর্শকের মনে ভয় ধরাতে বাধ্য। তবে এর সঙ্গে মিল রয়েছে বাস্তব ঘটনারও।
২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের হাসপাতালেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাব দেখা দিয়েছিল। কাফিল খান নামে সেখানকার এক চিকিৎসক নিজের খরচে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শত চেষ্টার পরেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এনসেফাল্যাইটিসে আক্রান্ত ৬৩ জন শিশু।
কাফিলের দাবি, হাসপাতালের পরিস্থিতি উচ্চ আধিকারিকদের জানানো হলেও কোনও লাভ হয়নি। বরং শিশুদের মৃত্যুর পর মিথ্যা অভিযোগে কাফিলকে জেলে পাঠানো হয়। ২০২১ সালে এই ঘটনা নিয়ে একটি বইও লেখেন তিনি।
‘জওয়ান’ মুক্তির পর ছবিনির্মাতা-সহ শাহরুখকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কাফিল। কাফিল বলেন, ‘‘বড় পর্দায় আসল অপরাধী সাজা পেয়ে যায়। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। আমার সঙ্গে আরও ৮১টি পরিবার আজও ন্যায়ের পথ চেয়ে বসে রয়েছে।’’ বাস্তবের কাফিলই কি শাহরুখের ছবিতে ইরাম হয়ে উঠল?
মুফাসা এবং তার পুত্র সিম্বা। বাবা-ছেলের সম্পর্কের পাশাপাশি বন্ধুত্বের-ভরসার সম্পর্ক তাদের। ‘দ্য লায়ন কিং’ ছবিতে মুফাসা-সিম্বা জুটি দর্শকের মন কাড়ে।
‘জওয়ান’ ছবিতেও টেনে আনা হয়েছে মুফাসা-সিম্বার কথা। আজাদকে তুলনা করা হয়েছে সিম্বার সঙ্গে। বিক্রম রাঠৌর অর্থাৎ আজাদের বাবার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মুফাসার নাম। ‘জওয়ান’-এর দু’টি চরিত্রেই শাহরুখ যেন সিংহ।
মুফাসা-সিম্বার সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে শাহরুখের জীবনেও। ২০১৯ সালে মুক্তি পায় ডিজ়নির ‘দ্য লায়ন কিং’। ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি ভাষাতেও ডাবিং হয় ‘দ্য লায়ন কিং’-এর। হিন্দি ভাষায় ‘দ্য লায়ন কিং’ ছবিতে মুফাসার কণ্ঠ দিয়েছিলেন শাহরুখ। সিম্বার নেপথ্যকণ্ঠে ছিলেন শাহরুখ-পুত্র আরিয়ান খান।
১৯৮৪ সালে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কারও অজানা নয়। দেশের উন্নয়নের জন্য মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে— এই দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন অনেকে। ‘জওয়ান’ ছবির অন্তিম পর্বে সেই ঘটনার ছিটেফোঁটা ভেসে ওঠে পর্দায়। বড় বড় কারখানায় তালাও লাগাতে দেখা যায় ‘জওয়ান’-এর দৃশ্যে।
লাল রঙের ট্যাবলেট নাকি নীল রঙের? একটি রঙে মৃত্যু, একটি রঙে মন শান্ত করার হদিস। ‘জওয়ান’ ছবিতে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দক্ষিণী অভিনেতা বিজয় সেতুপতি। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে লাল এবং নীল রঙের ট্যাবলেটের প্রসঙ্গ বার বার উঠে এসেছে। এই দৃশ্যেও রয়েছে বলিউডি ছাপ। ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবির কিনু রিভসের কথাও মনে করিয়ে দিতে পারে এই দৃশ্য।
ঋণ মেটাতে না পেরে বহু কৃষক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন— ‘জওয়ান’ ছবিতে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে বাস্তবের মিল রয়েছে। একাংশের দাবি, এই দৃশ্য বাস্তবে কৃষি বিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যে বিল কৃষক আন্দোলনের মুখে পড়ে শেষমেশ প্রত্যাহার করে নিতে হয়।
২০২১ সালে কর্ডেলিয়া প্রমোদতরীতে মাদক পাচারের খবর পেয়ে অভিযান চালায় নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)। সেখান থেকেই মাদক পাচারের অভিযোগে পাকড়াও করা হয় শাহরুখ-পুত্র আরিয়ানকে। অভিযোগের ভিত্তিতে ২৫ দিনের হাজতবাসও হয় আরিয়ানের। মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সমীর ওয়াংখেড়ের নামও। কর্ডেলিয়া প্রমোদতরী সংক্রান্ত মাদককাণ্ডের তদন্তভারের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন সমীর। সেই সময় শাহরুখের পরিবারের উপর দিয়ে কম ঝড় বয়ে যায়নি।
ঘটনার দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও গণমানসে এখনও সজীব আরিয়ান খান মাদককাণ্ড। তবে ‘জওয়ান’ মুক্তির পর আবার নতুন করে চর্চার কেন্দ্রে ওই মামলার তৎকালীন তদন্তকারী আধিকারিক এবং প্রাক্তন এনসিবি কর্তা সমীর। ‘‘বেটে কো হাত লাগানে সে পহেলে বাপ সে বাত কর’’— এ কি শুধুমাত্রই ‘জওয়ান’-এর সংলাপ, নাকি ব্যক্তিগত স্তরে কাউকে খোঁচা দিলেন শাহরুখ?
শাহরুখের ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ— ‘‘রাহুল, নাম তো শুনা হোগা?’’ শাহরুখের পুরনো ছবির সংলাপ আবার নতুন করে ফিরে এল ‘জওয়ান’-এ। বড় পর্দায় শাহরুখ বলে উঠলেন, ‘‘রাঠৌর... বিক্রম রাঠৌর... নাম তো শুনা হোগা?’’
‘জওয়ান’ ছবিতে আজাদের জন্মের সময় শিশুটিকে হাতে নিয়ে উপরের দিকে তোলা হয়। ‘দ্য লায়ন কিং’-এ এমন দৃশ্য ছিল। এমনকি এসএস রাজামৌলির ‘বাহুবলী’ ছবিতেও অনুরূপ দৃশ্য রয়েছে। ‘জওয়ান’ ছবিতে এক চরিত্রকে বাহুবলী নামে ডাকা হয়েছে।
ক্রিস্টোফার নোলানের পরিচালনায় ২০১২ সালে মুক্তি পায় ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’। এই ছবিতে বেন নামে এক খলচরিত্রের মুখে এক ধরনের মুখোশ দেখা গিয়েছিল। একই ধরনের মুখোশ পরে দেখা গিয়েছে ‘জওয়ান’-এর একটি চরিত্রকেও। তার পোষ্য হিসাবে একটি চিতাকে দেখানো হয়েছে ‘জওয়ান’-এ।
২০০৫ সালে এস শঙ্করের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘অপরিচিত’। ছবির মুখ্যচরিত্র আন্নিয়ানকে এই ছবিতে বিশেষ মুখোশ পরে দেখা যায়, যা পরলে মুখের অর্ধেক অংশ ঢাকা থাকে। ‘জওয়ান’-এও শাহরুখকে একই ধরনের মুখোশ পরে দেখা গিয়েছে।
‘জওয়ান’-এর ‘জ়িন্দা বান্দা’ গানের দৃশ্যে নৃত্যশিল্পীদের হলুদ-কালো পোশাকে দেখা যায় যা, হলিউডি ছবি ‘কিল বিল’-এ উমা থার্মানের কথা মনে করিয়ে দেয়।
চুরুট খেতে খেতে বেল্ট দিয়ে একের পর এক দুষ্টু লোককে মেরে যাচ্ছে বিক্রম। ‘জওয়ান’ ছবিতে এই অ্যাকশন দৃশ্য দুর্দান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শাহরুখ। এই বেল্ট দেখে কি ‘শোলে’ ছবির গব্বর সিংহের কথা সিনেপ্রেমীদের মনে উঁকি মারতে বাধ্য।
৭ সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমীর দিন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘জওয়ান’। ছবিতে আজাদের জন্ম হয় কারাগারে। কৃষ্ণের জন্মকাহিনির সঙ্গে কি কোনও ভাবে মিল রাখা হয়েছে? এই কারণেই কি জুন থেকে পিছিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তির দিন ঠিক করা হয় ‘জওয়ান’-এর? এ কি শুধু আশ্চর্য সমাপতন? এখন সকলের চোখ বক্স অফিসের অঙ্কের দিকে। বক্স অফিসে ইতিমধ্যেই সফল ‘জওয়ান’। শেষ ভাল যার, তার সব ভাল।
সকল ছবি সংগৃহীত।