ইরান এবং পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইরান এবং পাকিস্তান একে অপরের উপর হামলা চালিয়েছে। দাবি, উভয় ক্ষেত্রেই হামলার লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।
পাকিস্তানের বালুচিস্তানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং জবাবে ইরান সীমান্তে পাকিস্তানের পাল্টা হানায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ‘বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি’ তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করে দিয়েছে।
ইরান ঘেঁষা পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত বরাবরই উত্তপ্ত থাকে। সেখানে একাধিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ঘাঁটি রয়েছে বলে অভিযোগ। ভারতের মতো পাকিস্তানকে নিয়ে নাজেহাল তার পশ্চিমের পড়শি ইরানও।
তবে সম্প্রতি ইরানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের মাটিতে তাদের হামলা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছে। পাকিস্তানের দাবি, ইরানের হামলায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ইরান জানিয়েছে, তাদের হামলার লক্ষ্য ছিল জঙ্গি সংগঠন জইশ অল অদল বা ‘আর্মি অফ জাস্টিস’-এর ঘাঁটি। তারা এর আগে ইরানের মাটিতে একাধিক হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ।
অনেকে মনে করছিলেন, বালুচিস্তান প্রদেশকে নিয়ে ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত। কিন্তু ইরানের হামলা এবং পাকিস্তানের প্রতি-হামলার নেপথ্যে আদৌ বালুচিস্তান নেই। রয়েছে অন্য এক শহর।
ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরেই চাপা দ্বন্দ্ব চলছে। সম্প্রতি সংঘাতের বারুদ হিসাবে উঠে এসেছে ইরানের কেরমান শহর। চলতি মাসের শুরুর দিকে সেখানে ভয়াবহ ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটে।
গত ৩ জানুয়ারি ইরানের জনপ্রিয় জেনারেল কাসেম সোলেমানির মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধা জানাতে কেরমান শহরে তাঁর কবরের সামনে বহু মানুষ জমায়েত করেছিলেন। বিস্ফোরণে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
ইরানে ওই হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন আইসিস। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, হামলায় জইশ অল অদলের হাত আছে বলে প্রমাণ পেয়েছিল ইরান। সেই প্রমাণ নাকি পাকিস্তানের সামনে রাখাও হয়েছিল।
প্রমাণ দেখিয়ে জইশ অল অদলের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদকে পদক্ষেপ করতে বলেছিল তেহরান। তারা এ-ও দাবি করেছিল যে, আগামী দিনে ওই সংগঠন ইরানের মাটিতে আরও বড় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে।
কিন্তু অভিযোগ, প্রমাণ পেয়েও নিজেদের সীমান্তের মধ্যে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনটির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি পাকিস্তান। তারা ইরানের বক্তব্যকে গুরুত্বই দেয়নি। পাকিস্তানের এই ‘আলগা’ মনোভাবই ইরানকে রুষ্ট করেছে।
কেরমানে বিস্ফোরণের পরেই তেহরানের তরফে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানানো হয়েছিল, তাঁদের দেশের উপর কোনও রকম হামলা ক্ষমা করা হবে না। প্রত্যেক হামলার যোগ্য জবাব দেওয়া হবে।
ইরান ঘেঁষা পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চলছে বলে অভিযোগ। দীর্ঘ দিন ধরেই তা নিয়ে ইসলামাবাদকে সতর্ক করেছে তেহরান।
কেরমানে বিস্ফোরণ ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে তারই জবাব দিতে চেয়েছে তেহরান। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের শক্তির প্রমাণও দিয়েছে নতুন করে।
পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের যুদ্ধে ইরানের অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম থেকেই তারা হামাসের পক্ষ নিয়ে এসেছে। হামাসকে সমর্থন করে লেবানন এবং ইয়েমেনের যে সংগঠন গর্জে উঠেছে, তাদের পাশেও দাঁড়িয়েছে ইরান।
হামাস এবং সহযোগী সংগঠনগুলিকে অস্ত্র, অর্থ এবং সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করছে ইরান, দাবি তেমনটাই। হামাসের অনেক নেতা ইরানে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন বলেও শোনা যায়।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম এশিয়া যখন যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন এশিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে পাকিস্তানের মাটিতে ইরানের হামলা বিশ্বের নজর ঘুরিয়ে দিয়েছে।
ইরানের মাটিতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলার কড়া সমালোচনা করেছে তেহরান। পাকিস্তানের অন্যতম বরিষ্ঠ কূটনীতিককে এই হামলার জবাবদিহি করতে তেহরানে তলব করা হয়েছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ভারতেই একাধিক বার পাক মদতে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে।
তবে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ ঘনিষ্ঠতা যে ইরান আর সহ্য করবে না, গত মঙ্গলবার তা-ই বুঝিয়ে দিয়েছে তেহরান। পাকিস্তান নিয়ে অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে তারা।
ইরানের সঙ্গে সংঘাতের আবহে পাকিস্তানে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আগামী দিনে ইরানের দিক থেকে আরও বড় কোনও হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং গোয়েন্দাকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছেন পাকিস্তানের তদারকি সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনওয়ার-উল-হক কাকর।
সব ছবি: সংগৃহীত।