ভারতের মতোই রাশিয়ার ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তান! মস্কোর সঙ্গে তাই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে ইসলামাবাদ। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়িয়ে ফের এক বার রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইনের চুক্তি সারল শাহবাজ় শরিফ সরকার। এর ফলে আমেরিকার ‘বিষ নজর’ ইসলামাবাদের উপর পড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের ১২ ডিসেম্বর রাশিয়ার সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক সারেন পাক সরকারের পদস্থ কর্তারা। এর পরই দুই দেশ শক্তি ক্ষেত্রে (এনার্জি সেক্টর) একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সেরেছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ‘পাকিস্তান স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন’ (পিএসজিপি) প্রকল্প। এ ছাড়াও তেল ও গ্যাসের খোঁজে ইসলামাবাদকে সাহায্য করবে মস্কো।
গত ন’বছরে শক্তি ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার কাছাকাছি যাওয়া এবং হাত ধরে চলার কম চেষ্টা করেনি পাকিস্তান। কিন্তু প্রতি বারই আমেরিকার চাপে ইসলামাবাদের যাবতীয় স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, দুই মহাশক্তির মাঝে পড়ে একরকম স্যান্ডউইচ হচ্ছে পাকিস্তান। এ বারের চুক্তির পরও যার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্রের খবর চুক্তি অনুযায়ী, মস্কোর সাহায্যে পিএসজিপি শেষ করার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে ইসলামাবাদ। ২০১৫ সালে থেকে দুই দেশের মধ্যে এই নিয়ে একাধিক বার চুক্তি হয়েছে। কিন্তু কোনও বারই তা বাস্তবের মুখ দেখতে পায়নি। এই ইস্যুতে বিরক্তি প্রকাশও করেছে রাশিয়া।
পাকিস্তান স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের মূল রূপকার হলেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ়)-এর নেতা নওয়াজ় শরিফ। সম্পর্কে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়ের দাদা তিনি। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন করাচি থেকে লাহোর পর্যন্ত এই গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেন তিনি।
ইউরোপের শীতপ্রধান দেশগুলিতে এই ধরনের গ্যাস পাইপলাইনের বহুল ব্যবহার রয়েছে। সেখানে গ্যাসের সাহায্যে বাড়ির ভিতরের ঘরগুলিকে গরম রাখা হয়। নওয়াজ় সরকার ঠিক একই কারণে ওই গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু, আর্থিক দিক থেকে সেই সঙ্গতি না-থাকায় বিনিয়োগকারী খুঁজতে শুরু করে ইসলামাবাদ।
নওয়াজ়ের সাধের পিএসজিপি প্রকল্পে প্রায় ১,১০০ কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইন বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে পাক সরকারের। এর আনুমানিক খরচ ওই সময়ে (পড়ুন ২০১৫ সাল) ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলার ধার্য করা হয়েছিল। ভারতীয় মুদ্রায় টাকার অঙ্কটি প্রায় ১৭ হাজার কোটি। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ইসলামাবাদ।
গ্যাস পাইপলাইন বসানোর কাজে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ দিনের। জার্মানি-সহ ইউরোপের একাধিক দেশে পাইপের সাহায্যেই গ্যাস সরবরাহ করে থাকে মস্কো। শুধু তা-ই নয়, নিজের দেশের মধ্যেও জালের মতো গ্যাস পাইপলাইন বিছোনোর কাজ করেছে সেখানকার একাধিক সংস্থা। আর সেই কারণেই পিএসজিপি প্রকল্পের বরাত রাশিয়াকে দিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল নওয়াজ় সরকার।
২০১৫ সালে এই পাইপলাইন তৈরি নিয়ে চুক্তি করে দুই দেশ। সেখানে বলা ছিল, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পরবর্তী ২৫ বছর ধরে পিএসজিপি থেকে আয় হওয়া যাবতীয় অর্থ পাবে মস্কো। কিন্তু, ঘরোয়া রাজনৈতিক কোন্দলে এই প্রকল্প শুরু করতে ব্যর্থ হয় ইসলামাবাদ।
২০১৭ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান নওয়াজ় শরিফ। তাঁকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা তথা বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান। ইসলামাবাদের ক্ষমতাবদলে নির্বাসিত হন নওয়াজ়। পাকিস্তান ছেড়ে লন্ডনে চলে যান তিনি।
২০২১ সালে নতুন করে পিএসজিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলতে শুরু করেন ইমরান খান। ঠিক তার পরের বছর মস্কো সফরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। প্রকল্প শেষ করতে রাশিয়াকে নতুন অফার দেন ইমরান। যদিও তাতে নিজের বিপদই ডেকে আনেন তিনি।
পুতিন-ইমরান বৈঠকে প্রকল্পটির ৭৪ শতাংশ মালিকানা পাকিস্তানের কাছে থাকবে বলে ঠিক হয়। বাকি ২৬ শতাংশ মালিকানা পাবে মস্কো। সেখানে আরও বলা ছিল, পিএসজিপি থেকে ২৫ বছর নয়, আজীবন আয় করতে পারবে রাশিয়া। এতে লাভের অঙ্ক কমছে বলে মনে হলে মালিকানার শতাংশ বাড়িয়ে ৪৯ করার সুযোগ পাবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সে ক্ষেত্রে ৫১ শতাংশ মালিকানা থাকবে ইসলামাবাদের হাতে।
ইমরানের দেওয়া এই প্রস্তাব লাভজনক বলে মনে হয়েছিল রুশ আধিকারিকদের। ফলে ফের এক বার পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করেন তাঁরা। ঠিক হয়, ৫৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ করাচিতে পাঠাবে মস্কোর গ্যাস সংস্থা। কিন্তু, ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাতের ঠিক পরদিনই ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযানের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ শুরুর তারিখটি ছিল ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।
রুশ সেনার কিভে আক্রমণ শুরু করার সময়ে মস্কোর হোটেলে ছিলেন ইমরান। ওই সময়ে ক্রমাগত আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন তিনি। চিনের সঙ্গেও ইসলামাবাদের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল। মস্কোর সঙ্গে ইসলামাবাদের এই মাখামাখি একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি ওয়াশিংটন। ফলে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ছক কষতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।
২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যেই পাক পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে আস্থা ভোটে হেরে যাওয়ায় পতন হয় ইমরান সরকারের। প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ় শরিফ। একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন পিটিআই কর্ণধার। সেই থেকে জেলবন্দি রয়েছেন ইমরান খান। তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটানোর নেপথ্যে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা ‘সিআইএ’র হাত থাকার অভিযোগও উঠেছিল।
ইমরান প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি হারানোর পর পিএসজিপি নিয়ে আর কোনও উৎসাহ দেখায়নি মস্কো। অন্য দিকে এই প্রকল্প নিয়ে নাছোড়বান্দা ইসলামাবাদ ২০২৩ সালে ফের এক বার নতুন অফার নিয়ে রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়। এ বার করাচির সঙ্গে বালুচিস্তানের গ্বাদর বন্দর জুড়ে নিয়ে লাহোর পর্যন্ত পাইপলাইন তৈরির প্রস্তাব পেশ করে শাহবাজ় সরকার।
বার বার কাজ ভেস্তে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ রাশিয়া প্রথমে এ ব্যাপারে রাজি ছিল না। পরে অতিরিক্ত লাভের সুযোগ থাকায় সিদ্ধান্ত বদল করে। জিটি গ্লোবাল নামের রুশ সংস্থাকে কাজের বরাত দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিটি গ্লোবালের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা। ফলে, আবার কপাল পোড়ে পাকিস্তানের।
চলতি বছরের অক্টোবরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’র (সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও) বৈঠকের আয়োজন করে ইসলামাবাদ। সেখানে হাজির ছিলেন রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন। তাঁর সঙ্গে পিএসজিপি নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনা সারেন ইসলামাবাদের পদস্থ কর্তারা। ঠিক হয়, রাশিয়ার থেকে অপরিশোধিত তেলও কিনবে পাকিস্তান।
তবে আমেরিকার ‘ভয়ে’ গোটা বিষয়টি প্রথম থেকেই গোপন রেখেছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু সমাজমাধ্যমে রুশ প্রধানমন্ত্রী মিশুস্টিন এই সংক্রান্ত একটি পোস্ট করলে পাক আধিকারিকদের যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে পাল্টা বিবৃতি দেন শাহবাজ় সরকারের পেট্রলিয়ামমন্ত্রী মুসাদ্দিক মালিক।
মালিক জানিয়েছেন, রাশিয়ার থেকে তেল কেনার কোনও কথা হয়নি। গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পটির বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন অবশ্য এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে ১২ ডিসেম্বর হওয়া চুক্তি শেষ পর্যন্ত কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
সব ছবি: সংগৃহীত।