আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তার পরই এ দেশের মাটিতে পা রাখবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর ভারত সফরের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমেরিকা-সহ গোটা পশ্চিমি বিশ্ব। পাশাপাশি নয়াদিল্লিকে কী কী হাতিয়ার তিনি উপহার দিতে চলেছেন, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
পুতিনের সফরে ফের এক বার মস্কো-নয়াদিল্লি প্রতিরক্ষা চুক্তির সম্ভাবনা থাকায় একাধিক মারণাস্ত্রের কথা বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। সেই তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ‘ওরেশনিক’ আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম)। চলতি বছরের ২১ নভেম্বর এটির সাহায্যে ইউক্রেনীয় শহর ডেনিপ্রোকে নিশানা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
রুশ সংবাদ সংস্থাগুলির দাবি, শব্দের চেয়ে ১০ গুণ গতিতে (১০ ম্যাক) উড়ে গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে ওরেশনিক। অর্থাৎ, অতি উন্নত ‘হারপারসোনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র এটি। সেকেন্ডে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার বেগে ছোটার ক্ষমতা রয়েছে এই ওরেশনিকের। এর সাহায্যে একসঙ্গে ছ’টি লক্ষ্যে আঘাত হানা যায়।
‘অপারেশন ডেনিপ্রো’র পর প্রেসিডেন্ট পুতিন দাবি করেন, কোনও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) পক্ষে ওরেশনিককে চিহ্নিত করে মাঝ আকাশে ধ্বংস করা অসম্ভব। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল) পথ পেরিয়ে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রটি তাঁদের উপর আছড়ে পড়ে বলে স্বীকার করে নিয়েছে ইউক্রেনের ফৌজি গুপ্তচর বিভাগ।
এই আবহে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফরের মুখে সম্ভাব্য ‘ওরেশনিক’ চুক্তির বিষয়টি উস্কে দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনা অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন উত্তম কুমার দেবনাথ। রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের অস্ত্রাগারে এই ধরনের হাতিয়ার থাকা খুবই প্রয়োজন। প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে মস্কোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই মারণাস্ত্র তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে নয়াদিল্লির।’’
এ ব্যাপারে রুশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের উদাহরণ দিয়েছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন দেবনাথ। বর্তমানে এ দেশের মাটিতেই তৈরি হচ্ছে এর একাধিক ভ্যারিয়েন্ট। ‘‘মস্কো কখনওই জটিল ও উন্নতি হাতিয়ারের প্রযুক্তি নয়াদিল্লির হাতে তুলে দিতে পিছপা হয়নি। ওরেশনিক এ দেশের মাটিতে তৈরি হলে দু’দেশের জন্যেই তা লাভজনক হবে।’’ সাক্ষাৎকারে বলেছেন বায়ুসেনার প্রাক্তন অফিসার।
দ্বিতীয়ত, এ বারের সফরে ‘৩এম২২ জ়ারকন’ হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, এর আদলেই ‘ব্রহ্মস ২’ হাইপারসোনিক ক্রুজ়় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করবে নয়াদিল্লি। অর্থের অভাবে সেই প্রকল্প কিছুটা থমকে গিয়েছে। উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধে এই হাতিয়ারটিও ব্যবহার করেছে রুশ ফৌজ।
সূত্রের খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৩) জ়ারকনের প্রযুক্তি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে মস্কোর সঙ্গে কথা বলেছিল নয়াদিল্লি। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও মূলত যুদ্ধের কারণে প্রযুক্তি হস্তান্তরের থেকে পিছিয়ে আসে রাশিয়া। পুতিন এলে সেই সমস্যা মিটিয়ে ব্রহ্মস ২ তৈরির লক্ষ্যে দ্রুত গতিতে ভারত এগোতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দীর্ঘ দিন ধরেই ফাইটার জেটের সমস্যায় ভুগছে ভারতীয় বায়ুসেনা। ফলে রুশ প্রেসিডেন্টের সফরে এই সংক্রান্ত চুক্তির সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। বছর কয়েক আগে পঞ্চম প্রজন্মের ‘এসইউ-৫৭ ফ্যালকন’ স্টিলথ জেট যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিল রাশিয়া। অতিরিক্ত দাম-সহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত যা গ্রহণ করেনি নয়াদিল্লি।
সংবাদ সংস্থা ‘দ্য ইউরেশিয়া টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুতিনের ভারত সফরের মুখে ফের এক বার সেই প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। শুধু তাই নয়, এক ঝটকায় ‘এসইউ-৫৭’ দাম কিছুটা কমিয়েছে রাশিয়া। এই যুদ্ধবিমানকে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রে সাজানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি, এসইউ-৫৭ সরবরাহের ক্ষেত্রে রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) ও রুবেল (রুশ মুদ্রা) লেনদেন হলেও আপত্তি নেই বলে স্পষ্ট করেছে ‘বাদামি ভালুকের দেশ’।
এ ছাড়া ‘এসইউ-৭৫ চেকমেট’ যুদ্ধবিমান নিয়েও প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ইতিমধ্যেই এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই ফাইটার জেট ভারতের মাটিতে তৈরির প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে মস্কো। আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) ‘অ্যারো ইন্ডিয়া’ এয়ার শো-তে এই যুদ্ধবিমানের শক্তি প্রদর্শন করবেন রুশ বায়ুবীরেরা। ফলে তার আগে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল বলে জানিয়েছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা।
রুশ সংস্থা ‘সুখোই ডিজিটাই ব্যুরো’-র তৈরি এসইউ-৭৫ চেকমেটের এক একটির দাম তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি। সর্বোচ্চ গতিতে শব্দের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ জোরে (১.৮ ম্যাক) ছুটতে পারে এই যুদ্ধবিমান। স্থলভাগ থেকে ৫৪ হাজার ১০০ ফুট উঁচুতে আট টন হাতিয়ার নিয়ে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে পঞ্চম প্রজন্মের এই ফাইটার জেটের। আকাশ থেকে আকাশ এবং আকাশ থেকে ভূমি— দু’ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম রুশ এসইউ-৭৫ চেকমেট।
এ বছরের নভেম্বরে রুশ কৌশলগত বোমারু বিমান ‘টিইউ ১৬০’-কে নিয়ে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘দ্য ইউরেশিয়া টাইম্স’। সেখানে বলা হয়েছে, মস্কোর তরফে এই বোমারু বিমান সরবরাহের প্রস্তাব পেয়েছে নয়াদিল্লি। টিইউ ১৬০-এর কোড নাম আবার ‘সাদা রাজহাঁস’ (হোয়াইট সোয়ান) রেখেছে রুশ বায়ুসেনা। ইউক্রেন যুদ্ধে ‘কার্পেট বম্বিং’ চালিয়ে এর ধ্বংসক্ষমতা ইতিমধ্যেই গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে পুতিন ফৌজ।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) আরও জোরদার করতে গত নভেম্বরে রাশিয়ার সঙ্গে একটি মউ চুক্তি সই করেছে ভারত। সেখানে শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের হানা ঠেকাতে নতুন হাতিয়ার নয়াদিল্লির হাতে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে মস্কোর। পুতিন এলে মউ চুক্তিটি চূড়ান্ত রূপ পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নয়াদিল্লি-মস্কো মউ প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে ‘ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড’ ও রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র রফতানিকারক সংস্থা ‘রোজ়োবোরাএক্স’-এর মধ্যে। সেখানে ‘পন্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’-এর কথা বলা হয়েছে। হাতিয়ারটি এ দেশের মাটিতেই তৈরি করা হবে বলে জানা গিয়েছে।
সমর বিশেষজ্ঞেরা পন্টসারকে বহুমুখী ও উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলেছেন। এটি বিমান ও ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে বহুস্তরীয় সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এতে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমানবিধ্বংসী কামান— এই তিন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে যা উন্নত রাডার এবং ট্র্যাকিং সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। ৩৬ কিমি দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করতে এবং সেগুলিকে ধ্বংস করতে সক্ষম পন্টসার।
পন্টসার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একটি ট্রাকের উপর রাডার, ১২টি ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমান বিধ্বংসী দু’টি কামান থাকে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সাধারণ ভাবে ১৮ কিলোমিটার পাল্লার। কিন্তু নতুন ‘পন্টসার এস-১’ সংস্করণে ‘বুস্টার’ ব্যবহার করে সেগুলির পাল্লা বাড়িয়েছেন রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার একটি ইউনিটে ৩০ মিমি স্বয়ংক্রিয় কামান যুক্ত করা আছে। এই অটোক্যানন প্রতি মিনিটে ৭০০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে সক্ষম। ৪ কিলোমিটার পাল্লার মধ্যে থাকা উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। মাঝারি পাল্লার ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে সক্ষম।
খোদ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রাসাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োজিত রয়েছে পন্টসার এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রুশ প্রেসিডেন্টকে বিশেষ সুরক্ষা দিতে সোচির প্রাসাদে মোতায়েন করা হয়েছে এটিকে। ইউক্রেনীয় ড্রোন হানা আটকাতে এই ব্যবস্থা বলে জানা গিয়েছে।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) গোড়ায় ভারত সফরে যাবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম বার নয়াদিল্লি আসছেন তিনি। যদিও তাঁর সফরের সময়সূচি এখনও ঘোষণা করেনি মস্কো।
সব ছবি: সংগৃহীত।