ফুটবল বা হকি ম্যাচ নয়। মরণ-বাঁচন রণক্ষেত্রে সেমসাইড! অবাধ্য ইউক্রেনকে শায়েস্তা করতে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু এতে নিশ্চিন্ত হওয়া তো দূরে থাক, উল্টে এই সিদ্ধান্তের জন্যই এখন পস্তাতে হচ্ছে মস্কোকে। শত্রুকে ছেড়ে ‘ভুল করে’ রুশ বাহিনীর উপরেই গুলি চালিয়ে বসেছে পিয়ংইয়ং থেকে আসা সৈনিকেরা। ফলে দুশমন নয়, দোস্তের হাতেই প্রাণ গিয়েছে পূর্ব ইউরোপের ‘বাদামি ভালুকের দেশ’টির বেশ কয়েক জন ফৌজির।
সম্প্রতি ইউক্রেনের গোয়েন্দা দফতর এই খবর প্রকাশ্যে আনতেই ইউরোপ জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। কিভের দাবি, গত ১৪ ডিসেম্বর শনিবার এই ঘটনা ঘটে পশ্চিম রাশিয়ার কুর্স্ক এলাকায়। উত্তর কোরিয়ার সেনার গুলিতে সেখানে প্রাণ গিয়েছে মস্কোর অন্তত আট সৈনিকের। রাশিয়ার তরফে অবশ্য এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
কিভের গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, যুদ্ধের সময়ে রুশ সামরিক গাড়ির উপর আমচকা হামলা চালায় উত্তর কোরিয়ার ফৌজ। গাড়িতে ছিলেন মস্কোর ‘আখমত’ ইউনিটের সৈনিকেরা। অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান তাঁরা। সমম্বয়ের অভাব এবং ভাষাগত সমস্যার জেরে এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাল্টা প্রত্যাঘাত শানায় ইউক্রেনীয় সেনা। ট্যাঙ্ক এবং আত্মঘাতী ড্রোনের সাহায্যে উত্তর কোরিয়া এবং রুশ সৈনিকদের নিশানা করে তারা। ফলে ওই রণাঙ্গনে বড় লোকসানের মুখ দেখতে হয়েছে মস্কোর যৌথ বাহিনীকে। সব মিলিয়ে রুশ জোটের ২০০-র বেশি ফৌজি নিকেশ হয়েছে বলে দাবি করেছে কিভ।
সরকারি ভাবে বিবৃতি জারি না-হলেও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অন্য দিকে ‘বন্ধু’কে সাহায্য করতে গিয়ে মুখ পুড়েছে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিং জং-উনের। সূত্রের খবর, কুর্স্ক হত্যাকাণ্ডের পর ক্রেমলিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তিনি। গোটা ঘটনার দায় স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন কিম।
অন্য দিকে, আগামী দিনে যৌথ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দূর করতে কঠোর নিয়ম চালু করেছেন রুশ ফৌজি জেনারেলরা। ইউক্রেনে অপারেশনের সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ এক ধরনের বৈদ্যুতিন যন্ত্র ব্যবহার করে আসছে পুতিন সেনা। উত্তর কোরিয়ার বাহিনীকেও সেগুলি দেওয়া হয়েছিল। আপাতত তা বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মস্কো।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, কুর্স্কের ঘটনা দুই দেশের সেনা অফিসারদের অপদার্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পিয়ংইয়ংয়ের বাহিনী যে রাশিয়ায় মানিয়ে নিতে পারেনি, তা স্পষ্ট। উত্তর কোরিয়ায় ইন্টারনেটের ব্যবহার খুবই সীমিত। সেই কারণে অত্যাধুনিক পুতিন ফৌজের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে যুদ্ধ করতে সমস্যা হচ্ছে তাঁদের।
চলতি বছরের অগস্টে ঝটিতি আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিম রাশিয়ার কুর্স্ক এলাকা দখল করে নেয় ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির বাহিনী। এর পরই ক্রেমলিনের প্রাসাদে বসে ওই এলাকা পুনরুদ্ধারের ছক কষতে শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। প্রায় তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে প্রচুর সৈনিক খুইয়েছে মস্কো। আর তাই ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ‘বন্ধু’ কিমের শরণাপন্ন হন তিনি।
গত বছর (পড়ুন ২০২৩) উত্তর কোরিয়া সফরে গিয়ে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। সেখানেই যুদ্ধের প্রয়োজনে সৈনিক আদানপ্রদানের কথা বলা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী মস্কোয় কয়েক হাজার ফৌজির একটি দল পাঠান কিম। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কুর্স্কে মোতায়েন করেন ক্রেমলিনের সেনাকর্তারা।
আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) ২০ জানুয়ারি আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির জন্য প্রবল চাপের মুখে পড়বে রাশিয়া। আর তাই দ্রুত কুর্স্ক পুনরুদ্ধারে উঠেপড়ে লেগেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
এই পরিস্থিতিতে রণকৌশলে বড় বদল আনতে পারে ক্রেমলিন। পিয়ংইয়ং থেকে আসা সৈনিকদের কুর্স্ক থেকে সরিয়ে রিজ়ার্ভ বাহিনী হিসাবে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করছে মস্কো। সেই জায়গায় নিজেদের সৈনিকদের এনে রুশ জেনারেলরা আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ালে বেকায়দায় পড়তে পারে জ়েলেনস্কির বাহিনী।
নভেম্বরের মাঝামাঝি কুর্স্কের ৪০ শতাংশ এলাকা মস্কো পুনর্দখল করতে পেরেছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। এতে অবশ্য পিয়ংইয়ংয়ের বাহিনী খুব একটা সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন না কোনও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞই। তবে আগামী দিনে ভ্রান্তি এড়াতে দুই দেশ যে যৌথ সামরিক মহড়ায় জোর দেবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয়ত, কুর্স্ক রণাঙ্গনে এই ভুলের পরেও উত্তর কোরিয়ার সৈনিক সরবরাহ আপাতত বন্ধ করছে না মস্কো। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’র কাছে মুখ খুলেছেন দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মরত ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূত দিমিত্রো পোনোমারেন। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু দিনের মধ্যেই পিয়ংইয়ং থেকে যাওয়া সৈনিকের সংখ্যা বেড়ে ১৫ হাজারে পৌঁছে যাবে। আগামী এক বছরের মধ্যে রুশ ভূখণ্ডে উত্তর কোরীয় ফৌজির সংখ্যা এক লাখ ছাপিয়ে যাবে।’’
‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজ়িক স্টাডিজ়’-এর উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ জোসেফ এস বারমুডেজ় জুনিয়র আবার বলেছেন, ‘‘দুই দেশের বন্ধুত্বের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা কখনওই একে অপরের ভাষা শেখার চেষ্টা করেনি। কুর্স্কে প্রাণ দিয়ে তারই খেসারত দিয়েছে রুশ সৈনিকেরা।’’
গত অক্টোবরে উত্তর কোরিয়ার সৈনিকদের সঙ্গে রুশ ফৌজি অফিসারদের কথোপকথনের একটি অডিয়ো রেকর্ডিংয়ে আড়ি পাতেন ইউক্রেনীয় গোয়োন্দারা। সূত্রের খবর, তখনই তাঁরা জানতে পারেন প্রতি ৩০ জন পিয়ংইয়ংয়ের সৈনিক পিছু এক জন করে দোভাষী নিয়োগ করেছে মস্কো। কিন্তু তার পরেও কুর্স্কের বিপর্যয় এড়ানো যায়নি।
কুর্স্কে নিহত রুশ সৈনিকেরা পুতিনের অনুগত চেচনিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা রামজ়ান কাদিরভের বাহিনীর অংশ ছিলেন বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। এরই পোশাকি নাম ‘কাদিওরোভাইটস্’। কুখ্যাত এই ফৌজের বিরুদ্ধে বহু বার গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। গত অগস্ট থেকে কুর্স্কে পুতিনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কাদিরভের এই বাহিনী।
ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়ার দিকে তাঁর নিজস্ব বাহিনী ‘ওয়্যাগনার গ্রুপ’কে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাঠান প্রেসিডেন্ট পুতিন। রাশিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীকে রিজ়ার্ভে রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন তিনি। পূর্ব ইউক্রেনের একাধিক শহর দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ‘ওয়্যাগনার গ্রুপ’। ওই সময়ে গোপনে কাদিরভকে যুদ্ধের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখার নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান চালাচ্ছে মস্কো। প্রায় তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা অবশ্য প্রকাশ করেনি ক্রেমলিন। অন্য দিকে গত নভেম্বরের একেবারে শেষে এসে নিহতের সংখ্যা জানিয়েছে জ়েলেনস্কির দফতর।
কিভের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আড়াই বছরে বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা। আহতের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৭০ হাজার। অন্য দিকে, নিহত ও আহত মিলিয়ে রাশিয়া হারিয়েছে প্রায় ছ’লক্ষ সৈনিক। যদিও এই পরিসংখ্যান পত্রপাট খারিজ করেছে মস্কো।
সব ছবি: সংগৃহীত।