মঙ্গলবার থেকে ভারতে রোড-শো শুরু করলেন মলদ্বীপের পর্যটনমন্ত্রী ইব্রাহিম ফয়জ়ল। সোমবার তিনি ভারত সফরে এসেছেন।
মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে, ১ অগস্ট মুম্বইয়ে এবং ৩ অগস্ট বেঙ্গালুরুতে তিনটি রোড-শো করার কথা ইব্রাহিমের।
‘ওয়েলকাম ইন্ডিয়া’ নামে ওই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য মলদ্বীপ থেকে মুখ ফেরানো ভারতীয় পর্যটকদের আবারও মলদ্বীপমুখী করা।
এই কৌশলগত প্রচারাভিযানটি মলদ্বীপ এবং ভারতের মধ্যে পর্যটন সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা বলে সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে।
এর আগেও ভারতীয়দের কাছে মলদ্বীপ পরিদর্শনের আর্জি জানিয়েছিলেন ইব্রাহিম। বলেছিলেন, ‘‘অনুগ্রহ করে মলদ্বীপে বেড়াতে আসুন। আমাদের অর্থনীতি পর্যটনের উপর নির্ভরশীল।’’
কিন্তু কেন এমন ভাবে পর্যটক ‘ভিক্ষা’ করতে ভারতে রোড-শো শুরু করতে হচ্ছে মলদ্বীপকে?
চিনপন্থী বলে পরিচিত মহম্মদ মুইজ্জু গত নভেম্বরে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন। তার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে মলদ্বীপের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন।
গত বছরের শেষে লক্ষদ্বীপ সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রশাসনিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত দ্বীপরাষ্ট্রের সমুদ্রসৈকতেও অনেকটা সময় কাটিয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ফিরে এসে সেই সফরের স্মৃতিচারণাও করেন মোদী। সফরে কাটানো মুহূর্তের প্রচুর ছবিও তিনি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন।
এর পরেই প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতকে নিয়ে কুমন্তব্য করেন মুইজ্জু সরকারের তিন প্রতিনিধি। অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী ছবিগুলি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার পর মলদ্বীপ সরকারের তৎকালীন তিন মন্ত্রী সেই ছবিগুলি নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রীকে ‘জোকার’ এবং ‘ইজ়রায়েলের ক্রীড়নক’ বলেও অপমান করা হয়। কটাক্ষ করা হয় ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়েও।
এর পরেই বিতর্কের মুখে পড়েন ওই তিন মন্ত্রী এবং মলদ্বীপ সরকার। বিতর্কের মুখে পড়ে নিজেদের পোস্টগুলিও মুছে ফেলেন তাঁরা। যদিও তত দিনে সেই সব পোস্টের ছবি (স্ক্রিনশট) সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে প়ড়েছে (যদিও সেগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। চাপের মুখে ওই তিন মন্ত্রীকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করে মুইজ্জুর সরকার।
ভারতের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে বিপদ বাড়ে মলদ্বীপের। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের উপরে অবস্থিত ছোট্ট যে দ্বীপরাষ্ট্র এত দিন ভারতীয়দের ভ্রমণের স্বপ্নরাজ্য ছিল, সেই মলদ্বীপকে বয়কটের ডাকও দেন ভারতীয়েরা।
‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর আওয়াজ তুলেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে শুরু করে ক্রিকেট মহলের তাবড় তারকারা। যে তারকারা ছুটি কাটাতে মলদ্বীপে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন, তাঁরাও মলদ্বীপ সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। মলদ্বীপ না গিয়ে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগুলিতে ছুটি কাটানোর আহ্বান জানান তাঁরা।
বছরখানেক আগেও বিলাসবহুল ভ্রমণের উদ্দেশে বিত্তশালী ভারতীয়দের ভিড় জমত মলদ্বীপে। ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রায় আড়াই-তিন লক্ষ ভারতীয় মলদ্বীপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই রীতিই রাতারাতি বদলে যায়।
ভারতীয়দের মলদ্বীপ ভ্রমণ কমে যাওয়ায় দ্বীপরাষ্ট্রের পর্যটনে ভাটা পড়ে। মলদ্বীপের অর্থনীতি পর্যটনের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় সে দেশের কোষাগারেও এর প্রভাব পড়ে। মলদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রকের তথ্যে দেখা গিয়েছে, এই বছরের শুরুতে মলদ্বীপে আসা ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৪২ শতাংশ কমেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ভারত থেকে ৭৩,৭৮৫ জন পর্যটক মলদ্বীপ গিয়েছিলেন। এ বছরের ওই একই সময়ের মধ্যে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২,৬৩৮।
এর পরেই নড়েচড়ে বসে পর্যটন বিভাগ। পর্যটনমন্ত্রীর তরফে বার বার ভারতীয়দের মলদ্বীপ ঘুরতে আসার আর্জি জানানো হয়। মে মাসের শুরুতে দ্বীপরাষ্ট্রের পর্যটনমন্ত্রী ভারতীয়দের কাছে সে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার আহ্বান জানান। কিন্তু বরফ গলেনি। তার অন্যতম কারণ ছিল মুইজ্জু সরকারের ‘ভারত-বৈরিতা’।
মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা ফেরত পাঠানো নিয়েও দু’দেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বলে মনে করছিলেন বিশেষজ্ঞেরা।
তবে ভারতীয় কূটনীতির জেরে নাকি ধীরে ধীরে সুর নরম করছে মুইজ্জু সরকার। তার পরেই আবার পর্যটক টানতে মলদ্বীপের পর্যটনমন্ত্রীর ভারতে রোড-শো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল।
সব ছবি: সংগৃহীত।