মহম্মদ মুইজ্জু। মলদ্বীপ রাষ্ট্রের নবম প্রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে শপথগ্রহণ করেছেন মাত্র ৫৭ দিন আগে। আর শুরুতেই তিনি জড়িয়ে পড়েছেন চরম বিতর্কে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে মলদ্বীপের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে তাঁর আমলে।
এর ফলে দেশের একাংশের বিরাগভাজন হয়েছেন মুইজ্জু। ভারতের বিরোধিতা অনেকে পছন্দ করছেন না। বিরোধী দলগুলি মুইজ্জুর ভারত বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে। চলছে প্রচার।
আবার ভারতের বিরোধিতা করে মলদ্বীপের একটা বড় অংশের মানুষের সমর্থনও পাচ্ছেন মুইজ্জু। তিনি নির্বাচনী প্রচারেও ভারতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। তার পর ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন।
রাজনীতির বাইরে এ হেন মুইজ্জুর জীবন কিন্তু বর্ণময়। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক রাজনীতিবিদকে চমকে দিতে পারে। আবার রাজনীতিতে মুইজ্জুর দক্ষতাও সর্বজনবিদিত।
মলদ্বীপের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় মাজিদিয়া স্কুলের ছাত্র মুইজ্জু। সেখান থেকে স্কুলের পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন লন্ডনে।
মুইজ্জু স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের ডিগ্রি রয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে। সেখান থেকেই পরে পিএইচডি করেন।
‘কংক্রিটের উপর তাপ এবং সময়ের প্রভাব’ নিয়ে পিএইচডি করেছেন মুইজ্জু। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু সে দিকে কেরিয়ার না গড়ে রাজনীতির দিকে ঝোঁকেন।
সরকারি চাকরি দিয়ে মুইজ্জুর কেরিয়ার শুরু হয়। ২০১২ সালে মলদ্বীপের হাউসিং এবং পরিবেশমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। সে সময় তিনি মলদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্সের (এমডিএ) সদস্য ছিলেন।
২০১৮ সালে এমডিএ ছেড়ে মুইজ্জু যোগ দেন প্রগ্রেসিভ পার্টি অফ মলদ্বীপ (পিপিএম)-এ। দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয় তাঁকে। এই সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন মুইজ্জু।
২০২১ সালে মলদ্বীপের রাজধানী মালের মেয়র নির্বাচিত হন মুইজ্জু। শাসকদল এমডিপি-র প্রার্থীকে হারিয়ে ওই পদ তিনি লাভ করেন। মেয়রের পদে ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল এমডিপি।
মলদ্বীপের বিরোধী জোটের অন্যতম অংশ পিপল্স ন্যাশনাল কংগ্রেস থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী করা হয় মুইজ্জুকে। নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়ে মুইজ্জু পেয়েছিলেন ৫৪ শতাংশ ভোট। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিকে হারিয়ে দেন তিনি। ১৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।
জনগণের সঙ্গে মিশে তাদের জন্য কাজ করা মুইজ্জুকে তৃণমূল স্তরে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম স্বাধীনচেতা মনোভাব।
মুইজ্জুর এই স্বাধীনচেতা মনোভাবই তাঁর সরকারের সঙ্গে ভারতের দূরত্বের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পরেই মুইজ্জু ঘোষণা করেন, তিনি মিত্র দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলবেন। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই মলদ্বীপের স্বাধীনতা, সার্বভৌমতা খর্ব হতে দেবেন না।
কোনও একটি দেশের সঙ্গে কখনও তাঁর সরকার একক ভাবে জোট বাঁধবে না বলে জানান মুইজ্জু। কুর্সিতে বসেই ঘোষণা করে দেন, মলদ্বীপের মাটি থেকে সরে যেতে হবে ভারতীয় সেনাকে।
মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাকে সরানোর পর চিন সফরে যান মুইজ্জু। চিনঘেঁষা বলে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন তিনি। ক্ষমতালাভের পরেই তাই ডাক পেয়েছিলেন জিনপিংয়ের।
মলদ্বীপের প্রেসিডেন্টের প্রথম সফর অবশ্য চিন ছিল না। মুইজ্জু প্রথমে গিয়েছেন তুরস্কে। সেখান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি হয়ে দেশে ফেরেন। তার পর পাঁচ দিনের জন্য চিনে যান।
চিন থেকে ফিরে মুইজ্জু ভারত বিতর্কের মাঝে মুখ খুলেছেন। কারও নাম না করেই শনিবার বলেছেন, ‘‘আমরা ক্ষুদ্র হতে পারি। কিন্তু তাই বলে আমাদের চমকানোর ছাড়পত্র আমরা কাউকে দিইনি।’’
এই মন্তব্যের মধ্যেও মুইজ্জুর স্বাধীনচেতা মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নাম উল্লেখ না করলেও পরোক্ষে ভারতের কাছে মাথা না নোয়ানোর বার্তাই দিচ্ছেন মলদ্বীপ প্রেসিডেন্ট।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অবমাননাকর মন্তব্যের পর মলদ্বীপ অভিযুক্ত তিন মন্ত্রীকে সাসপেন্ড করেছে। তবে এর থেকে বেশি মাথা নোয়াবে না মুইজ্জুর মলদ্বীপ, চিন থেকে ফিরে যেন সে কথাই স্পষ্ট করে দিলেন প্রেসিডেন্ট।
সব ছবি: সংগৃহীত।