সিরিয়ান অস্ত্রোপচার শুরু! লুটের মাল ভাগবাঁটোয়ারার মতো করে পশ্চিম এশিয়ার দেশটির উপর ছুরির কোপ পড়ার আশঙ্কা। সবচেয়ে বড় ভাগটা আগেভাগে তুলে নিতে আসরে নেমে পড়েছে একাধিক দেশ। পিছিয়ে নেই ইহুদিরাও। ‘গ্রেটার ইজ়রায়েল’ তৈরির স্বপ্নপূরণের পথে একে অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য পদক্ষেপ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
কাতারের সংবাদ সংস্থা ‘আল জ়াজিরা’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোলান মালভূমির দিক থেকে সিরিয়ার জমি দখল করা শুরু করেছে ইহুদি ফৌজ। ইতিমধ্যেই সেখানকার কৌশলগত এলাকাগুলিতে পা পড়েছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ)। শুধু তা-ই নয়, ইহুদি অধিকৃত জমি সংলগ্ন পাঁচটি গ্রামের সিরিয়ান নাগরিকদের ‘ঘরবন্দি’ থাকার সতর্কবার্তাও জারি করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর সিরিয়া ও ইজ়রায়েল সীমান্তে বাফার জ়োন তৈরি করা হয়। আল জ়াজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বার আইডিএফকে সেই এলাকা কব্জা করার নির্দেশ দিয়েছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সরকারি ভাবে অবশ্য এই ইস্যুতে একটি শব্দও খরচ করেনি তেল আভিভ।
সূত্রের খবর, চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পদস্থ সেনাকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন নেতানিয়াহু। পরে তিনি বলেন, ‘‘কয়েক দশকের পুরনো চুক্তি ভেঙে গিয়েছে। সিরিয়ার সেনাবাহিনী তাঁদের অবস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও শত্রুকে আমরা সীমান্তে আসতে দিতে পারি না। ফলে অবিলম্বে ওই এলাকার দখল নেওয়া খুবই জরুরি।’’
১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ‘ছ’দিনের যুদ্ধে’ (সিক্স ডে ওয়ার) মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডনের সম্মিলিত বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ইহুদি সেনা। লড়াই শেষে সিরিয়ার গোলান মালভূমি (গোলান হাইটস্), জর্ডনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জ়েরুজ়ালেম এবং মিশরের সিনাই উপদ্বীপ ও গাজ়া স্ট্রিপ পুরোপুরি চলে যায় ইজ়রায়েলের কব্জায়।
কিন্তু পরবর্তী কালে অধিকৃত এই সমস্ত জমির অনেকটাই প্রতিবেশী দেশগুলিকে ফিরিয়ে দেয় ইহুদিরা। গোলান মালভূমির একটা অংশ অবশ্য নিজেদের দখলে রেখে দেয় তেল আভিভ। সেখানে তৈরি করা হয় বাফার জ়োন। আমেরিকা ছাড়া দুনিয়ার অধিকাংশ দেশই আংশিক দখলে থাকা গোলান মালভূমিকে ইজ়রায়েলের অংশ বলে মান্যতা দেয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো গোলান মালভূমি সিরিয়ার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ছক কষছেন ইহুদি জেনারেলরা। আর তাই বাফার এলাকা সংলগ্ন ওফানিয়া, কুনেইত্রা, আল-হামিদিয়া, সামদানিয়া আল-গারবিয়া এবং আল-কাহতানিয়া গ্রামে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন তাঁরা। খুব দ্রুত সেখানকার নিয়ন্ত্রণ আইডিএফের হাতে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই ইস্যুতে সমাজমাধ্যমে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করেছেন ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনীর আরবি ভাষার মুখপাত্র কর্নেল আভিচায় আদ্রেই। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘আপনাদের ক্ষতি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু আইডিএফের সঙ্গে সম্মুখসমরে নামলে ফল ভাল হবে না। তখন চরম পদক্ষেপ করতে বাধ্য হব আমরা।’’
ইহুদি অধিকৃত গোলন মালভূমির যে জমি চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়, আপাতত সেখানে কৃষিকাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে আইডিএফ। নিরাপত্তার কথা মাখায় রেখে সেখানকার সমস্ত স্কুলে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস। কারণ, বাফার জ়োন পেরিয়ে আরও ভিতরের দিকে ঢুকলে সিরিয়ার দিক থেকে প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা করছেন ইজ়রায়েলি ফৌজি অফিসারেরা।
এ মাসের ৮ তারিখ (রবিবার) দামাস্কাসে বাশার-আল-আসাদ সরকারের পতন হলে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন। তিনি একে ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হিজ়বুল্লা’ দীর্ঘ দিন ধরেই আসাদের সমর্থন পেয়ে আসছে বলে বহু দিন ধরেই সুর চড়িয়ে যাচ্ছে তেল আভিভ।
ইজ়রায়েলি সংবাদ সংস্থাগুলি আবার দাবি করেছে, ৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ সিরিয়া ও রাজধানী দামাস্কাসের হাতিয়ারের গুদামে বিমানহানা চালিয়েছে আইডিএফ। ইহুদি বিরোধীদের হাতে যাতে ওই অস্ত্র চলে না যায়, তাই এই ব্যবস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেনা অফিসার বলেছেন, ‘‘ওখানে যা পরিস্থিতি তাতে জঙ্গিদের পক্ষে সরকারি হাতিয়ারের গুদাম লুট করা বিচিত্র নয়। সেটা হলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ত।’’
হিব্রু ভাষায় প্রকাশিত ইহুদি দৈনিক ‘ইয়েদিওথ আহরনোথ’ লিখেছে, ‘‘সিরিয়ার সেনাবাহিনীর ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের ডিপোগুলিকে নিশানা করা হয়েছে। ইজ়রায়েলের উপর যাবতীয় সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করতে এই পদক্ষেপ করেছে আইডিএফ।’’ যদিও এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়নি।
আল জ়াজিরা অবশ্য দাবি করেছে, সিরিয়ার তেলের ডিপো নিশানা করেছে ইহুদি বায়ুসেনা। এর ফলে দামাস্কাসের সেনা গোয়েন্দা ও শুল্ক দফতরে আগুন ধরে যায়। এর নেপথ্যেও ইহুদি ফৌজের হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও তার কোনও প্রমাণ কাতারের এই সংবাদ সংস্থা দাখিল করতে পারেনি।
সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স’ আবার জানিয়েছে, দামাস্কারের কাফর সুসা জেলার নিরাপত্তা কমপ্লেক্সে বড় আঘাত হেনেছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমে সিরিয়া ফৌজের মাজেহ্ বিমানঘাঁটিও উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই এলাকায় আগেও হামলা হয়েছে। ৮ ডিসেম্বরের ধ্বংসলীলা ইহুদিরা চালিয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়।
অন্য দিকে লেবানন-সিরিয়া সীমান্তের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আল জ়াজিরার প্রতিনিধি। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘আসাদের পতনের সুযোগ নিচ্ছে ইজ়রায়েল। প্রতিবেশীকে দুর্বল করাই তাঁদের উদ্দেশ্য। আঞ্চলিক উদ্দেশ্য পূরণের দিকে এগিয়ে চলেছে ইহুদিরা।’’
২০০০ সালের জুলাইয়ে হাফেজ় আল আসাদের মৃত্যুর পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন তাঁর পুত্র বাশার। প্রথম দিন থেকেই রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন পেয়ে এসেছেন তিনি। পরবর্তী দশকগুলিতে তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরশাসন চালানোর অভিযোগ ওঠে। ২০১১ সালে আসাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে যুদ্ধে নামলে পর্দার আড়ালে থেকে তাঁদের মদত দিতে শুরু করে আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পেয়ে এই গোষ্ঠীগুলি আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ানোয় সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গত ১৩ বছর ধরে এর জেরেই রক্তে ভিজেছে পশ্চিম এশিয়ার দেশটির মাটি। অবশেষে ৮ তারিখ দামাস্কাসের দখল নেয় ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’ নামের দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী। এর জেরে পতন হয় আসাদ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, গৃহযুদ্ধে আসাদের সরকারি বাহিনীর পরাজয়ের নেপথ্যে রয়েছে ইজ়রায়েলের হাত। গত কয়েক মাসে একাধিক বার প্রতিবেশী দেশটিতে হামলা চালিয়েছে ইহুদি বায়ুসেনা। ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে আসাদ ফৌজ। যুদ্ধরত জোড়া সশস্ত্র গোষ্ঠী তার সুযোগ নিয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এত দিন পর্যন্ত সিরিয়াকে হাতিয়ার সরবরাহের করিডর হিসাবে ব্যবহার করছিল ইরান। তেহরানের মদতপুষ্ট হিজ়বুল্লার যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র পৌঁছত দামাস্কাস হয়ে। আসাদ সরকারের পতনের জেরে সেই রাস্তা বন্ধ হল বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, দক্ষিণ সিরিয়ার জমি কব্জা করতে ইহুদিদের একরকম ‘সাদা চেক’ লিখে দিয়েছেন বিদ্রোহীরা।
ইজ়রায়েল ছাড়া সিরিয়ার উত্তর দিকের অংশ তুরস্কের দখলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিদ্রোহীদের কাছে সরাসরি সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে আঙ্কারা। এই ভাগবাঁটোয়ারার জেরে পশ্চিম এশিয়ার দেশটি আদৌ অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।