ইজ়রায়েলের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে ইরানের। এই পরিস্থিতিতে নিজের দেশকেই হুঁশিয়ারি দিলেন ইরানের শীর্ষনেতা আয়াতুল্লাহ অল খামেনেই! খামেনেই জানিয়েছেন, ইরান যদি ইজ়রায়েল আক্রমণের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটে, তা হলে ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’-এর মুখে পড়তে হবে তাঁর দেশকে।
ইরান ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী খামেনেই বলেছেন, ‘‘সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক— কোনও কারণে যদি ইরান পিছু হটে, তা হলে পবিত্র কোরান অনুযায়ী ‘ঐশ্বরিক ক্রোধ’কে আমন্ত্রণ জানানো হবে।’’
পাশাপাশি খামেনেইয়ের অভিযোগ, ইরান যাতে ইজ়রায়েলকে আক্রমণ না করে, তা সুনিশ্চিত করার জন্য শত্রুরা নানা পরিকল্পনা করছে। শত্রুর ক্ষমতাকে বেশি ক্ষমতাশালী দেখিয়ে ইরানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।
গত ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে খুন হন স্বাধীনতাপন্থী প্যালেস্টাইনি গোষ্ঠী হামাসের সর্বেসর্বা ইসমাইল হানিয়া। দাবি ওঠে, হানিয়াকে খুন করা হয়েছে রিমোট কন্ট্রোল বোমার সাহায্যে। তাঁকে খুন করতে নাকি দু’মাস আগে ইরানের রাজধানী তেহরানের সেই গেস্ট হাউসে দূরনিয়ন্ত্রক বোমা বসিয়েছিল ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।
এর পরেই হানিয়া খুনের জন্য ইজ়রায়েলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার হুঙ্কার দেয় ইরান। চলতি মাসের শুরুতে ইজ়রায়েলের ওপর সরাসরি হামলা চালানোর নির্দেশও দিয়েছিলেন খামেনেই।
সেই ঘটনার দু’সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখনও ইজ়রায়েলকে নিয়ে কোনও কড়া পদক্ষেপ করেনি তেহরান। ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না গ্রহণ করার জন্য নিজের দেশকেই এ বার সতর্ক করেছেন খামেনেই।
সেই আবহে প্রশ্ন উঠছে, এত হম্বিতম্বি করেও কেন ইজ়রায়েলকে আক্রমণ করছে না ইরান? নিজের দেশকেই বা কেন ঈশ্বরের দোহাই দিতে হচ্ছে খামেনেইকে? তা হলে কি ইরানের বুকে গুরুত্ব হারাচ্ছেন সর্বোচ্চ নেতা? তাঁর কথা আর শোনা হচ্ছে না? আর সেই কারণেই এই সতর্কবার্তা?
এই সব প্রশ্নের সঙ্গে উঠে আসছে একটি নামও। তিনি মাসুদ পেজ়েশকিয়ান। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েই তেহরানে খুন হন হামাস নেতা হানিয়া।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ইরান যে ইজ়রায়েলে আক্রমণ করছে না, তার নেপথ্য কারণ হতে পারেন এই পেজ়েশকিয়ান।
গত ১৯ মে পূর্ব আজ়ারবাইজানে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ে ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির চপার। তাতে ছিলেন ইরানের বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদোল্লাহিয়ানও। দুর্ঘটনায় দু’জনেরই মৃত্যু হয়।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট রইসির মৃত্যুর পর অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবর।
ইরানের সংবিধান মেনে প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর ৫০ দিনের মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট (অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট), পার্লামেন্টের স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধানকে নিয়ে গঠিত ‘কাউন্সিল’ দেশে নতুন করে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। সেই নির্বাচনেই কট্টর রক্ষণশীল প্রতিদ্বন্দ্বী সঈদ জালিলিকে হারিয়ে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন পেজ়েশকিয়ান।
যদিও চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগেই রাজধানী তেহরান এবং অন্য কয়েকটি শহরে রাস্তায় নেমে উল্লাস শুরু করেন পেজ়েশকিয়ানের সমর্থকেরা। যার মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ প্রজন্মের। এই সংক্রান্ত অনেক ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছিল। তবে ইরানীয় তরুণদের মধ্যে পেজ়েশকিয়ানকে নিয়ে উন্মাদনার কারণ অন্য।
পেশায় শল্য চিকিৎসক পেজ়েশকিয়ান ইরানের রাজনীতিতে কট্টরপন্থী হিসাবে পরিচিত নন। তিনি পরিচিত সংস্কারপন্থী এবং মধ্যপন্থী হিসাবে। অর্থাৎ, সব পক্ষকে মানিয়ে-গুছিয়ে চলাই তাঁর নীতি।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রইসি আমেরিকার মতো পশ্চিমি বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তবে এ ক্ষেত্রে পেজ়েশকিয়ানের নীতি অন্য। তিনি বিশ্বাসী পশ্চিমি বিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে চলায়।
যে হিজাব নিয়ে রইসির বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, সেই বিষয়টিকেই হাতিয়ার বানিয়ে ভোটপ্রচারে নেমেছিলেন পেজ়েশকিয়ান। ইরানের মজ়লিসের সদস্য পেজ়েশকিয়ান প্রচারের সময় কুখ্যাত নীতিপুলিশের সমালোচনা করেন এবং ‘ঐক্য ও সংহতির’ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব থেকে ইরানের ‘আলাদা’ থাকার নীতি শেষ করার কথা বলেন।
পাশাপাশি, প্রচারে নেমে ইরানকে পশ্চিমি বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার এবং দেশের বাধ্যতামূলক হিজাব আইন সহজ করার প্রতিশ্রুতি দেন পেজ়েশকিয়ান। এর পরেই তাঁর সমর্থনে ঢল নামে তরুণদের।
এই পরিস্থিতিতে জল্পনা, প্রেসিডেন্টের আসনে বসেই আমেরিকার সঙ্গে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা শুরু করেছেন পেজ়েশকিয়ান। ইরানে বিনিয়োগ আনার দিকেও নাকি বিশেষ নজর দিচ্ছেন তিনি।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমি শক্তিগুলির সঙ্গে ২০১৫ সালের পরমাণু সমঝোতার পুনর্নবীকরণের জন্য ‘গঠনমূলক আলোচনা’ করার আহ্বান জানিয়েছেন পেজ়েশকিয়ান। পাশাপাশি তিনি পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞা থেকেও ইরানকে বার করে আনার চেষ্টা করছেন বলেও বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন।
অন্য দিকে, ইজ়রায়েল এবং আমেরিকার বন্ধুত্বের কথা সর্বজনবিদিত। এখন ইরান যদি ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায়, তা হলে সরাসরি আমেরিকার বিরোধিতা করা হবে। তা ভেবেই কি পিছিয়ে যাচ্ছেন পেজ়েশকিয়ান? ‘কথা’ শুনছেন না খোদ খামেনেইয়ের? উঠছে প্রশ্ন।
একই সঙ্গে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে এ-ও মনে করছেন, পুরো বিষয়টি বুঝতে পারছেন খামেনেইও। আর সেই কারণে নিজের দেশকেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন তিনি।
যদিও ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজ়েশকিয়ান প্রকাশ্যে সর্বোচ্চ নেতার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে পাশাপাশি তিনি এ-ও স্বীকার করেছেন যে, যুদ্ধ অবাঞ্ছিত হলেও ‘আগ্রাসীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নিশ্চিত করা হবে।
সব ছবি: সংগৃহীত।