অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সমান দাম। সেই সামান্য টাকার ড্রোনই এ বার বদলে দেবে যুদ্ধের গতি! বছর শেষে তেমনই বিস্ফোরকবোঝাই ‘আত্মঘাতী’ মানববিহীন উড়ুক্কু যান হাতে পেল ভারতীয় সেনা। বড়দিনের মুখে একে ফৌজের জন্য সান্তা বুড়োর সেরা উপহার হিসাবেই দেখছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত কয়েক বছর ধরে ড্রোন-শক্তি বাড়িয়ে চলেছে ভারত। সেই পথের নবতম সংযোজন হল ‘খড়্গ’। বিস্ফোরকবোঝাই এই ‘কমিকাজ়ে’ উড়ুক্কু যানটি তৈরি করেছে সেনাই। একে নজরদারি এবং প্রত্যাঘাত, দু’ধরনের কাজেই ব্যবহার করা যাবে বলে জানিয়েছে ফৌজ।
জাপানি শব্দ কামিকাজ়ের অর্থ হল ‘ঐশ্বরিক বাতাস’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আত্মঘাতী জাপানি যুদ্ধবিমানের পাইলটদের বলা হত কামিকাজ়ে। বর্তমানে আত্মঘাতী হামলা চালাতে সক্ষম ড্রোনগুলির দুনিয়া জুড়ে এই ধরনের নামকরণ করা হয়েছে। চিন, রাশিয়া, ইজ়রায়েল থেকে শুরু করে ইরান ও তুরস্কের মতো দেশের হাতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এই ‘কমিকাজ়ে’ ড্রোন।
ভারতীয় সেনার অস্ত্রাগারে জায়গা পাওয়া খড়্গ আত্মঘাতী ড্রোনটির শক্তি যে চিন ও পাকিস্তানের রাতের ঘুম উড়িয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। কম ওজনের উচ্চ গতির এই মানববিহীন উড়ুক্কু যানটিতে রয়েছে জিপিএস নেভিগেশন সিস্টেম এবং অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যামেরা। রণাঙ্গন থেকে অনেক দূরে বসে এই দুয়ের সাহায্যে শত্রুকে চিহ্নিত করে তার উপর নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারবে সেনা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, সেকেন্ডে ৪০ মিটার গতিতে ছুটতে পারে খড়্গ। ৭০০ গ্রাম বিস্ফোরক নিয়ে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে এর। দেড় কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে এক ঝটকায় উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খড়্গের জুড়ি মেলা ভার। ড্রোনটি ওজনে হালকা হওয়ায় খুব সহজেই এটিকে ওড়াতে পারবেন সৈনিকেরা।
খড়্গ যে মাটি থেকে অনেকটা উচ্চতায় উড়বে, তা কিন্তু নয়। বরং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থেকে শত্রুর উপর হামলা চালাবে এটি। সেনার পদস্থ কর্তাদের দাবি, অতি উন্নত রাডারের পক্ষেও খড়্গকে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। মাত্র ৩০ হাজার টাকায় এই ধরনের এক একটি ড্রোন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
চলতি বছরের অগস্টে ‘ন্যাশনাল অ্যারোস্পেস ল্যাবরেটরিজ’-এর (এনএএল) হাত ঘুরে প্রথম বার প্রকাশ্যে আসে এই শক্তিশালী স্বদেশি কামিকাজ়ে ড্রোন। খড়্গের ইঞ্জিন তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। পরবর্তী সময়ে ‘ডিফেন্স শো’-তে ড্রোনটিকে প্রথম বার প্রকাশ্যে আনেন তাঁরা।
সম্প্রতি রাজস্থানের মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে দু’দিনের মহড়ায় শক্তি প্রদর্শন করে এই ড্রোন। মহড়াটির নামও রাখা হয়েছিল ‘খড়্গ শক্তি’। হাতে পাওয়া নতুন আত্মঘাতী উড়ুক্কু যান ছাড়াও সেখানে সোয়ার্ম ড্রোন, কোয়াডকপ্টার এবং লজিস্টিক ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল।
মহড়া শেষে ভারতীয় সেনার ‘ড্রোন ফৌজি’দের সঙ্গে কথা বলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুষ্কর। এই সৈনিকমণ্ডলীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘খড়্গ কর্পস্’। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুষ্কর তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যে কোনও ফ্রন্টে চিন ও পাকিস্তানের আক্রমণ প্রতিহত করে তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানতে তাঁরা সক্ষম বলে জানিয়েছেন সেনার ওই শীর্ষ অফিসার।
ভারতীয় সেনায় খড়্গই প্রথম আত্মঘাতী ড্রোন, তা কিন্তু নয়। চলতি বছরের জুন থেকে ‘নাগাস্ত্র-১’ নামের একটি কামিকাজ়ে উড়ুক্কু যান ব্যবহার করা শুরু করেছে ফৌজ। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ওই ড্রোনটির নির্মাণকারী সংস্থা হল নাগপুরের ‘ইকোনমিক এক্সপ্লোসিভ লিমিটেড’।
১৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম নাগাস্ত্র ১-এর সাহায্যে দু’কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারবে সেনা। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল শত্রুরা জায়গা বদল করলে বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে একে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ড্রোনটির আরও উন্নত সংস্করণ তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে নাগপুরের সংস্থা। এ বছরের জুনে বরাত পাওয়া ৪৮০টির মধ্যে ১২০টি ড্রোন ভারতীয় সেনার হাতে তুলে দিয়েছে ইকোনমিক এক্সপ্লোসিভ লিমিটেড।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বহুল পরিমাণে খড়্গের মতো কামিকাজ়ে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি ও কনভয়ে এই ধরনের আত্মঘাতী উড়ুক্কু যান দিয়ে হামলা চালিয়েছে দু’পক্ষই। পাশাপাশি, বায়ুসেনার ঘাঁটি, তেলের ডিপো এবং হাতিয়ারের গুদাম অহরহ উড়িয়েছে খড়্গ-সম ড্রোন।
২০২০ সালে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজানের মধ্যে নাগোরনো কারাবাখের অধিকার নিয়ে চলা যুদ্ধে প্রথম বার বহু পরিমাণে ড্রোনের ব্যবহার লক্ক্ষ করেছিল গোটা বিশ্ব। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিই একরকম এর ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল। ওই সংঘাতের দিকে কড়া নজর রেখেছিলেন ভারতের ফৌজি অফিসারেরা। পরবর্তী বছরগুলিতে ড্রোন-শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দেন তাঁরা।
বর্তমানে ভারতীয় সেনার হাতে বিভিন্ন ধরনের ড্রোন রয়েছে। সেগুলির কোনওটি আত্মঘাতী, কোনওটি আবার শুধুই নজরদারির কাজে ব্যবহার করার জন্য। এই তালিকায় রয়েছে শিল্প সংস্থা টাটার তৈরি অ্যাডভান্স লয়েটারিং সিস্টেম ‘এএলএস-৫০’, ইজ়রায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়ের ‘স্পাইক ফায়ারফ্লাই’ এবং পোলিশ সংস্থা ওয়ারমেটের ‘এলবিট স্কাইস্ট্রাইকার’।
চলতি বছরেই ‘জোনেট জেএম-১’ লোটারিং ড্রোনের ১৫০ ইউনিট কেনার বরাত দিয়েছে ভারতীয় সেনা। অন্য দিকে, ‘তাপস’ এবং ‘আর্চার-এনজি’ নামের দু’টি মানববিহীন উড়ুক্কু যান তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডিআরডিও’। লম্বা দূরত্ব উড়ে গিয়ে এই দু’টি ড্রোন হামলা চালাতে পারবে বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়া আমেরিকা থেকে ৩০টি অত্যাধুনিক ‘এম কিউ-৯ রিপার’ (অন্য নাম প্রিডেটর বি) ড্রোন কিনছে নয়াদিল্লি। এগুলি অবশ্য আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যান নয়। সংশ্লিষ্ট ড্রোনগুলি থেকে ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ শানানো যায়। এই ড্রোন ব্যবহার করে ইরানি কম্যান্ডার কাসেম সুলেমানি এবং আল কায়দার শীর্ষনেতা আবু বকর অল জওয়াহিরিকে নিকেশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা।
ভারতীয় সেনা এমন একটা সময়ে খড়্গ আত্মঘাতী ড্রোন হাতে পাচ্ছে যখন বাংলাদেশের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। প্রতিবেশী দেশে মাথাচাড়া দিচ্ছে কট্টরপন্থা ও মৌলবাদ। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনার শক্তি নতুন কামিকাজ়ে ড্রোনটি যে অনেক অংশে বৃদ্ধি করল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সব ছবি: সংগৃহীত।