এগিয়ে চলেছে ভারতের অর্থনীতি। ফলে দিন দিন বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা, যার কাঁচামাল জোগাড় করতে অনেকাংশেই বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় নয়াদিল্লিকে। এ বার সেই সমস্যা সমাধানে জৈব শক্তির দিকে নজর দিয়েছে কেন্দ্র।
পরিসংখ্যান বলছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারের নিরিখে আমেরিকা ও চিনের পরেই রয়েছে ভারতের স্থান। দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শিল্পোৎপাদনের লেখচিত্র ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সেই চাহিদা বেড়েই চলেছে। গত ১০ বছরে প্রচলিত শক্তির ব্যবহার ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বা জ্বালানির ক্ষেত্রে ভারত মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, কয়লা ও খনিজ তেল ব্যবহার করেই এই চাহিদা মেটানো হয়। জ্বালানির ৫০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে নয়াদিল্লি।
২০২১-২২ আর্থিক বছরে প্রায় ২২ কোটি টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে ভারত। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে উন্নত মানের কয়লা কিনতেও বিপুল খরচ হচ্ছে নয়াদিল্লির। পাশাপাশি, এই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। ফলে এর ব্যবহার কমিয়ে জৈব শক্তির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
জৈব শক্তির একাধিক উৎস রয়েছে। তার মধ্যে বায়োডিজ়েল, ইথানল, বায়োমাস, বায়োগ্যাস ও গ্রিন হাইড্রোজেন উল্লেখযোগ্য। এই জৈব শক্তির উৎপাদন শহরাঞ্চলের বর্জ্য নির্গমনের সমস্যা মেটাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ বর্জ্য ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় বায়োমাস। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি সবুজ শক্তি প্রযুক্তি, যা কার্বন নিঃসরণকে কয়েক গুণ কমিয়ে দেবে।
জৈব শক্তির অন্যতম হল বায়োগ্যাস, যা দিয়ে গৃহস্থালি বা হোটেল-রেস্তরাঁয় রান্না করা যেতে পারে। মূলত, প্রাণিজ বর্জ্য থেকে এটি তৈরি করা হয়। এই শক্তি কৃষিতেও জৈব সার হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে বায়োমাসকে অতিরিক্ত জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এটি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে। কৃষি বর্জ্য ও অন্যান্য জৈব বস্তু ব্যবহার করে এটিকে তৈরি করতে হয়।
কয়লা ও খনিজ তেলের বিকল্প হিসাবে বায়োমাসকে পেতে হলে একটা উন্নত মানের কৃষি বর্জ্য ও জৈব বস্তু সরবরাহের শৃঙ্খল তৈরি করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কথায়, সে ক্ষেত্রে গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ভারতে মোট গবাদি পশুর সংখ্যা ৫৪ কোটির কাছাকাছি, যা বায়োগ্যাসের উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির পক্ষে যথেষ্ট ভাল। মাঝারি আকারের এই ধরনের একটি উৎপাদন কেন্দ্র থেকে দিনে ৩ থেকে ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
জৈব জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ইথানলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেও নজর দিয়েছে কেন্দ্র। এর জন্য আখ চাষে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইথানলের ব্যবহার পেট্রল ও ডিজ়েলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করবে।
জৈব জ্বালানির মধ্যে আগামী দিনে বিমানে ব্যবহৃত হবে বায়োজেট কেরোসিন। ২০২১ সালে এর চাহিদা ছিল শূন্য। তা ২০৩০ সালের মধ্যে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, তরল জৈব জ্বালানি আগামী দিনে সড়ক পরিবহণকে পুরোপুরি বদলে দেবে। ২০২১ সালে যেখানে দিনে ব্যবহার হত মাত্র ২.১ এমবিওই, ২০৩০ সালে সেই অঙ্ক বেড়ে ৮ এমবিওইতে গিয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পাবে গাড়ি বা যানবাহনে তরল জৈব জ্বালানির ব্যবহার।
জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে কেন্দ্র। ২০১৮ সালে তাই এই সংক্রান্ত একটি জাতীয় নীতির সূচনা করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেই লক্ষ্যে পেট্রোল-ডিজ়েলে বায়োইথানল মেশানোর কাজ শুরু হয়।
কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে বায়োইথানলের ব্যবহার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, যা বর্তমানে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে একে আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ‘আত্মনির্ভর ভারতের’ ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিশেষজ্ঞদের কথায়, ভারতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে জ্বালানির ক্ষেত্রে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। সে ক্ষেত্রে জৈব শক্তি বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
জৈব শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কয়লা বা খনিজ তেলের আমদানি কমাতে পারবে নয়াদিল্লি। দেশের মাটিতেই জৈব জ্বালানি উৎপন্ন হলে পরিবহণ খরচ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত বিমানের ভাড়া অনেক সস্তা হবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
তবে জৈব জ্বালানিকে ব্যবহারের উপযোগী করতে আরও বেশি সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বর্তমানে উত্তরপ্রদেশে এই ধরনের বেশ কিছু প্ল্যান্ট রয়েছে। এই সংখ্যা বৃদ্ধি করতে বাজেটে বেশি পরিমাণে অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।