দেশে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকারী যুদ্ধজাহাজ‘আইএনএস কৃপাণ’ ভিয়েতনামের হাতে তুলে দেওয়ার কথা জানাল ভারত। সোমবার নয়াদিল্লিতে ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল ফান ভ্যান গ্যাংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। তার পরই ভারতের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ মনে করছেন, ভারতের এই ‘উপহার’ ভিয়েতনামের নৌবাহিনী ‘ভিয়েতনাম পিপলস্ নেভি’র ক্ষমতা এক ধাপে অনেকখানি বৃদ্ধি করবে।
আইএনএস কৃপাণ ১৩৫০ টনেরএকটি ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ যা ভিয়েতনামের হাতে তুলে দেবে ভারত।
কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথের এই ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠছে, কেন চিনের প্রতিবেশী ভিয়েতনামের উপর এত সদয় হচ্ছে মোদী সরকার? কেনই বা নিজেদের যুদ্ধজাহাজ ‘উপহার’ দিচ্ছে ভিয়েতনামকে?
২০২২ সালে ভিয়েতনামের উপকূলে নৌযুদ্ধের মহড়া শুরু করার কথা ঘোষণা করেছিল চিনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ)। ওই এলাকায় বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধের ফরমানও জারি করা হয়েছিল। চিনা সামরিক তৎপরতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে ভিয়েতনাম সরকার।
২০২০ সালে দক্ষিণ চিন সাগরের বিতর্কিত প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের সর্ববৃহৎ দ্বীপ উডি আইল্যান্ডে চিনা ফৌজের যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জেরেও বেজিং-হ্যানয় উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
তার আগে ২০১৪ সালেও চিনের একটি খনিজ উত্তোলনকারী জাহাজ ভিয়েতনামের জলসীমায় ঢুকে খনন শুরু করায় দু’দেশের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
ভিয়েতনাম সরকারের অভিযোগ, নিয়মিত ভাবে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জ়োন) যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে চিন।এই সব নিয়ে বহু দিন ধরেই চিন এবং ভিয়েতনামের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে।
দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে চিনের বিরোধ নতুন নয়। এর আগেও ওই এলাকায় এমন একতরফা পদক্ষেপ করেছে বেজিং। তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই অসন্তোষ জানিয়ে আসছে ওই সাগরের আশপাশে থাকা দেশগুলি। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলির অভিযোগ, ওই সাগরকে নিজেদের ‘সাম্রাজ্য’ হিসাবে ব্যবহার করছে বেজিং।
অন্য দিকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও চিনের ‘সুসম্পর্কের’ কথাও অনেক দিন ধরে আলোচনায়। পূর্ব লাদাখে এবং অরুণাচল প্রদেশে চিনা আগ্রাসন থেকে শুরু করে জইশ-ই-মহম্মদের প্রধান মাসুদ আজহারের ভাই আব্দুল রউফকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি তালিকায় অন্তর্ভুক্তি আটকে দেওয়া পর্যন্ত নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে।
দু’দেশের মধ্যে সামরিক স্তরে একাধিক আলোচনা করেও কোনও মধ্যস্থতায় আসতে পারেনি দুই দেশ।
তাই অনেকের মত ‘শত্র্রুর শত্রু বন্ধু’ নীতির উপর ভর করে ভিয়েতনামের হাত শক্ত করতে চাইছে ভারত। আর সেই কারণেই ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক এবং সে দেশের হাতে যুদ্ধজাহাজ আইএনএস কৃপাণ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।
শুধু ভিয়েতনাম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত যৌথ মহড়া, সামরিক বিনিময় এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমেইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ফিলিপিন্সের মতো এশীয় দেশগুলির সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক উন্নত করছে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২৯০ কিলোমিটার পাল্লার ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য ফিলিপিন্সেরসঙ্গে৩৭কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের চুক্তির পর থেকেই এশিয়ার একাধিক দেশের সামরিক শক্তিবৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে ভারত।
ভিয়েতনামকে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে ভারত। সে দেশের হাতে আইএনএস কৃপাণ তুলে দেওয়াকে তারই প্রথম ধাপ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।
ভারত-ভিয়েতনামের এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়।উভয় পক্ষই একে অপরের ভূমিকায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বলেও সূত্রের খবর।
দু’দেশের মধ্যে আগামী দিনে ডুবোজাহাজ, যুদ্ধবিমান, সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ চলবে বলেও বৈঠক থেকে উঠে এসেছে।
উভয় মন্ত্রী প্রতিরক্ষা বিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি শিল্প সহযোগিতা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং বহুজাতিক সহযোগিতার উন্নয়নের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন বলেও সরকারি সূত্রে খবর।
ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন সংস্থা (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা ডিআরডিও)-র সদর দফতর পরিদর্শন করেন।
১৮ জুন দুই দিনের ভারত সফরে আসেন ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল গ্যাং। তিনি সোমবার জাতীয় যুদ্ধ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবকও অর্পণ করেন এবং নিহত বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক জন সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন, ভারতের কাছ থেকে আরও অনেক ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ভিয়েতনাম। নিজেদের প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলেও ওই কর্তা জানিয়েছেন।
সব ছবি: সংগৃহীত।