বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরের পরেই। তার পরেই ভারত এবং মোদীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে মলদ্বীপের তিন মন্ত্রী এবং শীর্ষ স্তরের বেশ কিছু রাজনীতিকের বিরুদ্ধে।
দেশের অন্দরে এবং বাইরে বিতর্কের ঝড় শুরু হতেই অভিযুক্ত তিন মন্ত্রীকে সাসপেন্ড করেন মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু। তার পরেও অবশ্য দুই দেশের সম্পর্ক খুব একটা সহজ হয়নি।
সমাজমাধ্যমে ভারতীয় নেটাগরিকদের ‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর ঠেলা সামলাতে হিমশিম খেতে হয় ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রকে। আগে থেকে মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার বিমান-হোটেলে টিকিট বুক করে রাখার পরেও তা বাতিল করেন একের পর এক ভারতীয়। এই প্রবণতা এখনও বন্ধ হয়নি।
এই বিতর্কের মধ্যেই পাঁচ দিনের চিন সফরে যান মুইজ্জু। গত শনিবার বেজিং থেকে দেশে ফেরার পরেই হুঁশিয়ারির সুরে তিনি জানান, ক্ষুদ্র দেশ হলেও মলদ্বীপকে ধমকানোর জন্য কোনও দেশকে ছাড়পত্র দেয়নি তাঁর সরকার।
কোনও দেশের নাম না করলেও মনে করা হয় যে, ভারতের উদ্দেশেই এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন তিনি। তার এক দিন পরেই ভারতকে ১৫ মার্চের মধ্যে মলদ্বীপ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার আর্জি জানায় মুইজ্জু সরকার।
গত নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পাওয়ার আগেও মলদ্বীপের রাজনীতিতে ‘চিনপন্থী’ রাজনীতিক হিসাবেই পরিচিত ছিলেন মুইজ্জু। নির্বাচনী প্রচারে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ সোলির ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ থেকে সরে এসে ‘ইন্ডিয়া আউট’-এর পক্ষে সওয়াল করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর পূর্বসুরীদের পথ অনুসরণ করে প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে আসেননি তিনি। নির্বাচনী প্রচারে যে ভারত নির্ভরতা কমানোর ডাক দিয়েছিলেন মুইজ্জু, প্রশাসক হয়েও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার ইঙ্গিত দেন।
এত দিন মলদ্বীপের বাসিন্দারা স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে মূলত ভারত এবং শ্রীলঙ্কার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। মলদ্বীপ সরকার বাসিন্দাদের জন্য বিনামূল্যে যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে থাকে, তাতে এত কাল অবধি রোগীদের ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় যেতে বলা হত।
কিন্তু গত শনিবার মুইজ্জুর সচিবালয়ের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এ বার থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং তাইল্যান্ডেও স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন মলদ্বীপের বাসিন্দারা।
সংবাদ সংস্থা এপি মুইজ্জুর সচিবালয়কে উদ্ধৃত করে জানায়, মলদ্বীপ এ বার সরাসরি আমেরিকা এবং ইউরোপের ওষুধ প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে ওষুধ আমদানি করবে। বিবৃতিতে কোনও দেশের নাম না করেই বলা হয়, কয়েকটি দেশের উপর নির্ভরতা কাটাতেই এই সিদ্ধান্ত।
২০২২ সালের পর্যটন সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর ভারতে আসা বিদেশিদের মধ্যে ১.৭ শতাংশ মলদ্বীপের বাসিন্দা। আবার ভারতে আসা মলদ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই এখানে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে আসেন। এ বার বিপুল জনস্রোতকে অন্য দেশে পাঠাতে চায় মলদ্বীপ।
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের জোগান নিশ্চিত করতে এত দিন ভারতের উপরেই ভরসা রাখত মলদ্বীপ। কিন্তু এই বিষয়েও ভারত নির্ভরতা কাটাতে সাম্প্রতিক চিন সফরে সে দেশের সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার চুক্তি করেছেন মুইজ্জু।
মনে করা হচ্ছে, এ বার চাল, চিনি, গম ইত্যাদি খাদ্যবস্তুর সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে নয়াদিল্লি নয়, বেজিংয়ের উপরেই নির্ভর করবে মলদ্বীপ। গত শনিবার মুইজ্জুর সচিবালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মলদ্বীপে খাদ্যবস্তু আমদানি করার ক্ষেত্রে একটা দেশের উপর নির্ভরতা বন্ধ করতে চায় সরকার।
এই ‘একটা দেশ’ যে ভারত, তো বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন নেই। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৫ সালের পর থেকে ক্রমশ মলদ্বীপে খাদ্যবস্তু রফতানিক পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে ভারত। কিন্তু এ বার সেই পরিমাণ কমার ইঙ্গিত মিলছে।
এত দিন মলদ্বীপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এবং শিল্পক্ষেত্রের নিরাপত্তা জোগানোর জন্য এবং প্রান্তবর্তী দ্বীপগুলিতে ত্রাণ এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৭৭-৮০ জন ভারতীয় সেনা সে দেশে ছিল। এ বার চিনা সেনাবাহিনীর একাংশকে এই কাজে মোতায়েন করতে পারে মুইজ্জুর সরকার।
ভারতের বিরুদ্ধে মলদ্বীপের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার অভিযোগ তুললেও মুইজ্জুর প্রশাসন কিন্তু সম্প্রতি সে দেশে চিনের একটি নজরদার জাহাজকে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। সূত্রের খবর, কলম্বো বিমানবন্দরকে পোতাশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করতে না-পেরে মলদ্বীপের কোনও বন্দরে ভিড়তে চলেছে সেটি।
চিন সফরের তৃতীয় দিনে গত বুধবার জিনপিংয়ের সঙ্গে রাজধানী বেজিংয়ে বৈঠক করেছিলেন মুইজ্জু। সেখানেই ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের আবহে মলদ্বীপের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন চিনা প্রেসিডেন্ট তথা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই বৈঠকেই বেজিংকে তাঁদের ‘পুরনো বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠতম সহযোগী’ বলেন মুইজ্জু। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক আর্থিক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা সংক্রান্ত কয়েকটি চুক্তি সই হয়। ওই চুক্তিগুলিতে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা-সহ একাধিক ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরতা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করা হয় বলে সূত্রের খবর।
সব ছবি: সংগৃহীত।