গ্রিনল্যান্ড দখলে মরিয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটি কব্জা করতে ইউরোপের ‘বন্ধু’ দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট? তাঁর একের পর এক হুঙ্কারের জেরে বরফের চাদরে ঢাকা ওই ‘সবুজভূমি’তে এ বার সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ফলে গ্রিনল্যান্ড ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন বা নেটো) ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি মুখ খোলেন ইইউ-এর মিলিটারি কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট ব্রিগার। জার্মান সংবাদপত্র ‘ওয়েল্ট অ্যাম সোন্ট্যাগ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘গ্রিনল্যান্ডে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত।’’ তাঁর এ হেন মন্তব্যের পরই আমেরিকা ও ইউরোপের ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের আশঙ্কা তীব্র হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি জার্মান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ব্রিগারের সাক্ষাৎকার। তার পরই দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে যায়। ব্রিগার বলেছেন, ‘‘গ্রিনল্যান্ডে ইইউ-ভুক্ত দেশগুলি সেনা পাঠালে একটা বার্তা দেওয়া যাবে। বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটির আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেটা হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’’ যদিও গ্রিনল্যান্ডে সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সদিচ্ছার উপর নির্ভর করবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ব্রিগারের ওই মন্তব্যের পর আরও এক ধাপ এগিয়ে এই ইস্যুতে সরাসরি আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করেছে ইইউ-এর অন্যতম সদস্য ফ্রান্স। গত ২৮ জানুয়ারি ফরাসি বিদেশমন্ত্রী জ়িন নোয়েল ব্যারট রেডিয়োয় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের বাহিনীকে গ্রিনল্যান্ডে পাঠানোর ব্যাপারটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।’’
অন্য দিকে গ্রিনল্যান্ড রক্ষা করতে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে ইইউ-ভুক্ত দেশ ডেনমার্ক। এ বছরের ২৭ জানুয়ারি, সুমেরু সাগর এলাকায় ফৌজিশক্তি মজবুত করতে ২০০ কোটি ইউরো খরচ করার কথা ঘোষণা করেছে কোপেনহেগেন। শুধু তা-ই নয়, বার্লিনে জার্মান চ্যান্সেলার ওলাফ স্কোলজ়, প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল মাকরঁ এবং নেটো প্রধান মার্ক রুটের সঙ্গে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বৈঠকও করেছেন ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন।
এ প্রসঙ্গে ইইউ প্রতিরক্ষা কমিশনর আন্দ্রিয়াস কুবিলিয়াস বলেছেন, ‘‘আমাদের সদস্য রাষ্ট্র ডেনমার্ককে রক্ষা করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে ফরাসি বিদেশমন্ত্রীর গলায়। ‘‘গ্রিনল্যান্ডের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখন শুধুই কোপেনহেগেনের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে না’’— সাক্ষাৎকারে বলেছেন ব্যারট। যদিও কবে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটিতে ইউরোপীয় ফৌজের পা পড়বে, তা স্পষ্ট নয়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার কথা বলেন ট্রাম্প। শপথের মুখে এ ব্যাপারে কথা বলতে ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটি কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয় কোপেনহেগেন। সূত্রের খবর, এর জেরে টেলিফোনে কথা বলার সময়ে মেজাজ হারান ট্রাম্প।
প্রসঙ্গত, সপ্তাহখানেক আগে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, ওই সুবৃহৎ দ্বীপটা আমরা পেতে চলেছি। গ্রিনল্যান্ডের উপর ডেনমার্কের কী ধরনের অধিকার রয়েছে, সেটা জানি না। এর আমেরিকায় সংযুক্তিতে কোপেনহেগেন বাধা দিলে তা একেবারেই বন্ধুত্বপূর্ণ হবে না। মুক্ত বিশ্বের সুরক্ষার জন্য এটা খুবই জরুরি।’’
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন ট্রাম্প। সেখানে গ্রিনল্যান্ড ইস্যুতে প্রশ্ন করা হলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি জানিয়ে দেন, দ্বীপটি কব্জা করতে প্রয়োজনে ফৌজকে কাজে লাগানো হবে। এর পরই ফুঁসে ওঠে ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং জার্মানি-সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের একাধিক দেশ। কড়া প্রতিক্রিয়া দেন গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও। ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাড়ছে রাজনৈতিক এবং সামরিক চাপানউতর।
বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড প্রকৃতপক্ষে একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। মূলত এটি ডেনমার্কের অংশ। আমেরিকার উত্তরে সুমেরু সাগর লাগোয়া এলাকায় এর অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের দ্বীপটি কব্জা করতে চাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, গ্রিনল্যান্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর খনিজ সম্পদ। সেই তালিকায় সোনা, তামা বা নিকেল ছাড়ায় বিপুল পরিমাণে লিথিয়াম এবং কোবাল্টের মতো দামি ধাতুও রয়েছে। মোবাইল, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক মোটর তৈরির কাজে এগুলি ব্যবহার হয়। আগামী দিনে সংশ্লিষ্ট ধাতুগুলির চাহিদা আকাশছোঁয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, গ্রিনল্যান্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর খনিজ সম্পদ। সেই তালিকায় সোনা, তামা বা নিকেল ছাড়ায় বিপুল পরিমাণে লিথিয়াম এবং কোবাল্টের মতো দামি ধাতুও রয়েছে। মোবাইল, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক মোটর তৈরির কাজে এগুলি ব্যবহার হয়। আগামী দিনে সংশ্লিষ্ট ধাতুগুলির চাহিদা আকাশছোঁয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে শুধুমাত্র খনিজ সম্পদের লোভে ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড দখল করতে চাইছেন, এটা ভাবলে ভুল হবে। তাঁর দাবি, সুমেরু সাগরের দিক থেকে অহরহ রুশ ডুবোজাহাজ ঢুকে পড়ছে আটলান্টিক মহাসাগরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দ্বীপে যাতায়াত রয়েছে চিনা রণতরীর। ফলে গ্রিনল্যান্ডকে কেন্দ্র করে যখন-তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাঁর।
ইউরোপের ২৮টি দেশের একটি সংগঠন হল ইইউ। ডেনমার্ক এর অংশ। ইইউ চুক্তির ৪২.৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনও সদস্য রাষ্ট্র সামরিক আগ্রাসনের শিকার হলে অন্য দেশগুলির তাকে বাধ্যতামূলক ভাবে সাহায্য করতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড আক্রমণ করলে জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দেশগুলি যে কোপেনহেগেনের পাশে দাঁড়াবে, তা বলাই বাহুল্য।
আটলান্টিকের তীরের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই তৈরি হয় নেটো। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি সৈন্যচুক্তি। সেখানে বলা হয়েছে, নেটোভুক্ত কোনও দেশ অপর রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে, সংগঠনের বাকি সদস্য দেশগুলি একে তাদের উপর হামলা বলে গণ্য করবে। এর পর সেই মতো আক্রমণকারী শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে নেটোর সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র।
বর্তমানে নেটোর সদস্য সংস্থা ৩২। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ রাষ্ট্রই এই সৈন্যচুক্তির আওতাধীন । গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে সুর চড়াতে থাকা ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং জার্মানিও নেটোভুক্ত রাষ্ট্র। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটির অধিকারকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি যে জটিল হচ্ছে, তা বলাই যায়।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর অবশ্য নেটো ত্যাগের ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প। তাঁর যুক্তি, এই সৈন্যচুক্তিতে থাকা অধিকাংশ দেশ প্রতিরক্ষা খাতে খুব কম টাকা খরচ করে। ফলে ইউরোপের একাধিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছে ওয়াশিংটনের।
গ্রিনল্যান্ডকে কেন্দ্র করে যুযুধান দুই পক্ষ লড়াইয়ের ময়দানে নামলে নেটোয় যে ফাটল ধরবে, তা নিশ্চিত ভাবে বলাই যায়। বিশ্লেষকদের একাংশের আবার দাবি, সংঘাত চরমে ওঠার আগেই নেটো ত্যাগ করতে পারেন ট্রাম্প। কারণ, ইতিমধ্যেই ইউরোপে মোতায়েন আমেরিকান সৈনিকদের ঘরে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশ মনে করেন, আমেরিকাবিহীন নেটোর অস্তিত্বই থাকবে না। সে ক্ষেত্রে পূর্ব ইউরোপে সীমানা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধা পাবে রাশিয়া। ফ্রান্স বা জার্মানির মতো ‘বন্ধু’কে হারালে চিনের বিরুদ্ধে মোর্চায় একা হয়ে পড়বে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেটা মোটেই সুখবর হবে না বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
আবার এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। গ্রিনল্যান্ড ইস্যুতে আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের কড়া সমালোচনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ানভুক্ত ফ্রান্স এবং জার্মানি। কিন্তু এই সংগঠনের অন্য দেশগুলি এই ইস্যুতে সে ভাবে মুখ খোলেনি। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপে সেনা পাঠাতে ইটালি, সুইডেন বা গ্রিসের মতো দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলি রাজি হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সম্প্রতি, গ্রিনল্যান্ড সফরে যান ট্রাম্প-পুত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র। সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে একটি ভিডিয়ো তুলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন তিনি। সেখানে ওই গ্রিনল্যান্ডবাসীদের আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ দেখা গিয়েছে। ফলে দ্বীপটি আমেরিকার সৈন্যরা কব্জা করলে তাঁদের থেকে প্রবল বাধা আসবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।