একের পর এক হাতির মৃত্যুতে রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে বান্ধবগড়ে। ইতিমধ্যে হাতির মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। প্রথমে ২৯ অক্টোবর বান্ধবগড় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের কোর খিতাউলি এলাকায় জঙ্গলে একসঙ্গে চারটি হাতির নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন বন দফতরের কর্মীরা। তাতেই সন্দেহ বাড়ে বনকর্মীদের। আশপাশের জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে আরও পাঁচটি হাতিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে সেই হাতিগুলিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
বহু নজরদারি সত্ত্বেও এড়ানো যায়নি হাতির মৃত্যু। ১ নভেম্বর মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় আরও একটি হাতিকে। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দলে মোট ১৩টি হাতি ছিল। তার মধ্যে দলের একমাত্র পুরুষ হাতি-সহ ১০টির মৃত্যু হয়েছে।
পর পর একসঙ্গে এতগুলি হাতির ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুতে সরব হয়েছেন পরিবেশকর্মীরা থেকে রাজনীতিবিদেরা। বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে তদন্ত শুরু হলেও হাতি মৃত্যুর সঠিক কারণ জানিয়ে মুখ খোলেনি প্রশাসন।
তবে প্রাথমিক ভাবে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, বিষক্রিয়াতেই মৃত্যু হয়েছে হাতিগুলির। মৃত হাতিগুলির সকলেরই পেটে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য পাওয়া গিয়েছে। তবে কী থেকে বিষক্রিয়া, না কি এর নেপথ্যে বড় কোনও চক্রান্ত কাজ করছে, তা নিয়ে এখনও সন্দিহান তদন্তকারীরা।
গত কয়েক বছরে পড়শি রাজ্য থেকে বান্ধবগড় ব্যাঘ্র প্রকল্পে হাতির আনাগোনা ক্রমেই বাড়ছে। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের বন্য বুনো শুয়োর, হরিণের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ রাজ্যের অতিথিদেরও সামাল দিতে হচ্ছে। ফসল নষ্ট করার কারণে প্রতি বছরই হাতিদের সঙ্গে লড়াই চলে কৃষকদের।
তিন দিনে ১০টি হাতির মারা যাওয়ার শোরগোলের মধ্যেই বান্ধবগড়ে শনিবার হাতির হামলায় মৃত্যু হয় এক প্রৌঢ়ের। ব্যাঘ্র সংরক্ষণ লাগোয়া জঙ্গলে প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়ে হাতির পায়ের পিষ্ট হয়ে মারা যান তিনি।
বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যানের কাছে অবস্থিত, মহামন নামের গ্রাম ও গদপুরী, সুলখানিয়া, পাটোর এবং পানপাথার মতো প্রতিবেশী গ্রামে প্রায়ই হানা দিয়ে ফসলের ক্ষতি করে যায় হাতির দল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তিগত সম্পত্তিও।
বর্তমানে বান্ধবগড় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায় প্রায় ৬০টি হাতি রয়েছে বলে মনে করা হয়। বান্ধবগড়ের গায়ে জাতীয় উদ্যানের তকমা ওঠে ১৯৬৮ সালে। ১৯৯৩ সালে প্রতিবেশী পানপাথা অভয়ারণ্যে প্রকল্পের অধীনে বান্ধবগড়কে বাঘের সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ভাবে উপযোগী করে তোলা হয়।
শুধুমাত্র ভৌগোলিক কারণে নয় বান্ধবগড়ের উল্লেখ মেলে প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রেও। মধ্যপ্রদেশের একেবারে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এবং সাতপুরা পর্বতশ্রেণির উত্তর প্রান্তে অবস্থিত বান্ধবগড়ে রাজত্ব করে গিয়েছে কলচুরি, সেঙ্গার এবং বাঘেল রাজবংশ।
বান্ধবগড়কে ঘিরে রয়েছে ২০টিরও বেশি স্রোতধারা। জোহিলা, জনধ, চারনগঙ্গা, দামনার, বনবেই, আম্বানালা এবং আন্ধিয়ারি ঝিরিয়া মতো ঝরনা মিশেছে শোন নদীতে। জীববৈচিত্রেও ভরপুর এই জাতীয় উদ্যানটি। বাঘের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হওয়ার পাশাপাশি ২২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং আড়াইশো প্রজাতির পাখি রয়েছে।
শিয়াল, ভালুক, ডোরাকাটা হায়েনা, চিতাবাঘ এবং বন্য শূকর ছাড়াও দেখা মেলে নীলগাই, চিঙ্কারা হরিণ এবং তৃণভোজী গৌরের। মাঝে এই জঙ্গল থেকে বিলুপ্ত হয় গৌর। ২০১২ সালে গৌরকে বান্ধবগড়ে ফিরিয়ে আনা হয়। কানহা জাতীয় উদ্যান থেকে বান্ধবগড়ে ৫০টি গৌর স্থানান্তর করা হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবমতে মাত্র ৭টি হাতির সন্ধান মিলেছিল মধ্যপ্রদেশ জুড়ে।
২০১৮ সালে প্রায় ৪০টি হাতির একটি পাল ছত্তীসগঢ় থেকে মধ্যপ্রদেশে চলে আসে বলে জানা যায়। এত বড় হাতির দলের পড়শি রাজ্য থেকে ঢুকে পড়ার ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। তবে এও বলা হয়ে থাকে, ভারতের মধ্যভাগে যে সব হাতি বাস করে তাদের আবাসস্থলের একটি অংশ মধ্যপ্রদেশও।
ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় এবং পশ্চিমবঙ্গের ২১ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি জুড়ে রয়েছে হাতিদের এই আবাসস্থল। কখনও কখনও মধ্যপ্রদেশ এবং বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। ২০১৭ সালের রাইট অফ প্যাসেজ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৩১২৮টি হাতির বিচরণ এলাকার মধ্যে পড়ে এই রাজ্যগুলি।
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে হাতিগুলি উত্তর ছত্তীসগঢ়ের সীমান্ত থেকে মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিংগ্রাউলি এবং অনুপপুরে থানা গা়ড়তে শুরু করেছে। বান্ধবগড় ব্যাঘ্র প্রকল্পের অবসরপ্রাপ্ত ফিল্ড ডিরেক্টর মৃদুল পাঠক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, এর আগে মধ্যপ্রদেশে হাতি প্রবেশ করত। খাবার ও জলের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই তারা আবার নিজের ডেরায় ফিরে যেত।
৮০ ও ৯০-এর দশকে ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড থেকে হাতির একটি ছোট দল ছত্তীসগঢ়ে এসে আশ্রয় নেয়। গত কয়েক দশক ধরে, এই দুই রাজ্যের বনভূমিতে অবৈধ দখল, শিল্পায়ন এবং খনির কারণে হাতিদের বসত এলাকা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।
ছত্তীসগঢ় এবং মধ্যপ্রদেশের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাঁশ, স্থায়ী ফসল এবং জলের অফুরান জোগানের কারণে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাতিরা বেছে নিচ্ছে মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় ও কানহার মতো সংরক্ষিত অরণ্যকে।
সব ছবি: সংগৃহীত।