ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গায়ে আঁচড়টি লাগলে চুপ করে বসে থাকবে না আমেরিকা। এ ক্ষেত্রে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র হলেও নিস্তার নেই। প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞার জাল ছিঁড়ে ধ্বংস করা হবে সেই দেশের অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদের এ হেন হুমকি ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গিয়েছে।
ইহুদি দেশটির পরম হিতাকাঙ্ক্ষী এই ব্যক্তির নাম লিন্ডসে গ্রাহাম। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো তিনিও রিপাবলিকান দলের সদস্য। আমেরিকার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষের ভোটে সেনেটর নির্বাচিত হয়েছেন গ্রামাস। নেতানিয়াহুকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ও কানাডার মতো দেশের বিরুদ্ধে শাসানির সুর শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়।
সম্প্রতি ইহুদি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি)। এর পরই ওই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্রিটেন। ফলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রে পা পড়লে নেতানিয়াহুকে যে হাতকড়া পরতে হবে, তা এক রকম স্পষ্ট।
ব্রিটেনের মতো একই সুর শোনা গিয়েছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর গলায়। ঐতিহ্যগত ভাবে এই দু’টি দেশ আমেরিকার ‘চিরকালীন বন্ধু’ হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। কিন্তু ইজ়রায়েল ইস্যুতে সেই মিত্রদের বিরুদ্ধেই ফুঁসে উঠলেন সেনেটর গ্রাহাম। যাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ়’-এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন গ্রাহাম। সেখানেই কোনও রকমের রাখঢাক না করে ইহুদি রাষ্ট্রপ্রধানের পাশে দাঁড়ান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে থাকা গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করা হলে সংশ্লিষ্ট দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তাব আনব।’’
এর পরই ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি এবং ফ্রান্সের নাম করেন গ্রাহাম। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, আমাদের বন্ধু দেশগুলিই আইসিসির নির্দেশ মানার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা।’’ আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার কথা বলেছেন রিপাবলিকান সেনেটর।
শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে ‘দুর্বৃত্ত’ বলতেও ছাড়েননি ট্রাম্পের দলের এই রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘‘আপনাকে আইসিসি আর আমেরিকার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। দ্বিতীয় হলোকাস্ট হওয়া থেকে নাগরিকদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে ইজ়রায়েল। এখানে অন্যায় খোঁজার কোনও মানে নেই।’’
গত বছরের (পড়ুন ২০২৩) ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে ইহুদি ভূমিতে আক্রমণ শানায় ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হামাস’। ওই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন নেতানিয়াহু। গাজ়ায় মারাত্মক বোমাবর্ষণ শুরু করে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) বিমানবাহিনী।
ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধ চলাকালীন ইহুদি ফৌজের বিরুদ্ধে বার বার উঠেছে গাজ়ায় গণহত্যার অভিযোগ। প্যালেস্তাইনপন্থীদের দাবি, স্কুল এবং হাসপাতালের উপর বোমাবর্ষণ করে আইডিএফ। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের হয়।
ওই মামলায় নাম রয়েছে ইজ়রায়েলের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টেরও। দু’জনের নামেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি। এই আদালতকে মান্যতা দিয়েছে বিশ্বের ১২৪টি দেশ। ওই রাষ্ট্রগুলিতে গেলে ইহুদি প্রধানমন্ত্রীর ধরা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। উল্লেখ্য, আইসিসিকে মান্যতা দেয়নি ভারত।
নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ট ছাড়া হামাসের সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষনেতা মহম্মদ দায়েফের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি। এ বছরের জুলাইয়ে বিমান হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইজ়রায়েল। যদিও তা এখনও স্বীকার করেনি ইরানের মদতপুষ্ট গাজ়ার ‘বিদ্রোহী’ সংগঠন।
আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। আয়ারল্যান্ড এবং ইতালি নেতানিয়াহুকে হাতকড়া পরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রোম অবশ্য ইহুদি প্রধানমন্ত্রী এবং হামাস নেতাকে এক সারিতে রাখা অনুচিত বলে মনে করে। অন্য দিকে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ডাবলিনের সঙ্গে ইজ়রায়েলের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
নেদারল্যান্ডস, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, বেলজিয়াম এবং তুরস্ক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ানের বিদেশ নীতির প্রধান জোসেফ বোরেল। তিনি আইসিসির পদক্ষেপকে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ বলে মানতে নারাজ।
অন্য দিকে, এই গ্রেফতারি পরোয়ানার কঠোর সমালোচনা করেছে হাঙ্গেরি এবং আর্জেন্টিনা। বুদাপেস্ট আইসিসির সিদ্ধান্তকে ‘আক্রোশজনক এবং নির্লজ্জ’ বলে উল্লেখ করেছে। আর এতে ইজ়রায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে দিয়েগো মারাদোনা-লিও মেসির দেশ।
আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন আমেরিকার বর্তমান প্রেসিজেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, ‘‘ইজ়রায়েল ও হামাসের মধ্যে একটা তুলনা টানার চেষ্টা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এটা অনুচিত।’’ সংশ্লিষ্ট পরোয়ানাটিকে প্রত্যাখান করেছে ওয়াশিংটন।
ইহুদি ভূমির নিরাপত্তার জন্য যে তারা দায়বদ্ধ, গত এক বছরে সেটা বহু বার বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইজ়রায়েলকে বিরাট অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজও দিয়েছে ওয়াশিংটন। এ বছরের অক্টোবরে আমেরিকার থেকে ‘থাড’ (টার্মিনাল হাই অলটিট্যুড এরিয়া ডিফেন্স) আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হাতে পেয়েছে আইডিএফ।
কিন্তু তার পরও গাজ়ায় আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ানোয় ইহুদি ফৌজের সমালোচনা করেছিল বাইডেন প্রশাসন। যুদ্ধবিরতির জন্য ইজ়রায়েলের উপর চাপ তৈরিতেও কসুর করেনি ওয়াশিংটন। এর কাছে মাথা না নুইয়েই যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন নেতানিয়াহু।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ওয়াশিংটনের সেই নীতিতে বদল আসতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, ভোট প্রচারে ইহুদি ভূমির প্রশংসা এবং একে রক্ষা করার ব্যাপারে যাবতীয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এ বার তাঁর দলেরই এক রাজনৈতিক নেতা খোলাখুলি ভাবে পাশে দাঁড়ালেন নেতানিয়াহুর।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে রাশিয়া। ফলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। এর জেরে গত দু’বছরে চিন এবং উত্তর কোরিয়া ছাড়া দেশের বাইরে পা রাখতে পারেননি মস্কোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
সব ছবি: সংগৃহীত।