তিন তিনটি বিয়ে করেছেন তরুণ। তিন স্ত্রীকে একই আবাসনে রেখেছিলেন। কিন্তু তিন জনেই ছিলেন আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে। অফিস যাওয়ার আগে তিন স্ত্রীর কাছেই হাজিরা দিতেন তরুণ। সংসারের দায়দায়িত্বও পালন করতেন হাসিমুখে। কিন্তু তিনটি বিয়েই লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর তিন স্ত্রী একে অপরকে চিনলেও তাঁরা যে এক স্বামীর সঙ্গেই ঘর বেঁধেছেন সে কথা জানতেন না। গল্পটি একটি হিন্দি ছবির। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কিস কিস কো প্যার করু’ নামের এই ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কপিল শর্মা। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য বহুল প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই সিনেমার গল্প এ বার বাস্তবের রূপ পেয়েছে।
উত্তর-পূর্ব চিনের জিলিন প্রদেশের বাসিন্দা শিয়াওজুন (নাম পরিবর্তিত)। শৈশব থেকেই অর্থাভাবে দিন কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু জীবনে অর্থের প্রাচুর্য চেয়েছিলেন। তাই তরুণীদের মিথ্যার জালে ফাঁসিয়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন তিনি। কারও সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলতেন। আবার কারও সঙ্গে পাততেন সংসার। চার বছর ধরে একই আবাসনে স্ত্রী এবং চার জন প্রেমিকার সঙ্গে ছিলেন তিনি। কিন্তু কখনও ধরা পড়েননি। ঘটনাটি চিনের। আর ‘নায়কের’ নাম শিয়াওজুন।
শিয়াওজুনের পিতা ছোটখাটো চাকরি করতেন। কিন্তু প্রতিটি চাকরিই ছিল অস্থায়ী। শিয়াওজুনের মাও চাকরি করতেন। কিন্তু তাঁর বেতন ছিল নামমাত্র। অর্থাভাবের কারণে তিন জনের সংসারেই টান পড়ত। টাকার অভাবে কলেজের পড়াশোনাও শেষ করতে পারেননি শিয়াওজুন। কিন্তু একটি বোধ জন্ম নিয়েছিল তাঁর মনে।
বিলাসিতায় মোড়া জীবন চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন প্রচুর অর্থ। এই মন্ত্রই যেন দিনরাত জপ করে যেতেন শিয়াওজুন। কিন্তু চাকরির সন্ধান করেননি কখনওই। বরং উপার্জনের জন্য তিনি বেছে নেন অন্য পথ। মিথ্যার জালে জড়িয়ে তরুণীদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করলেন শিয়াওজুন। সেই অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেও পিছপা হলেন না তিনি।
স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, শিয়াওজিয়া (নাম পরিবর্তিত) নামে এক তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয় শিয়াওজুনের। শিয়াওজুন ওই তরুণীকে প্রথম আলাপেই জানান যে, তাঁর পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে। সেই ব্যবসাই সামলান তিনি। বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেই অভ্যস্ত তিনি।
মাঝেমধ্যেই অনলাইনে শিয়াওজিয়াকে দামি দামি উপহার পাঠাতেন শিয়াওজুন। কিন্তু সেগুলি আদতে নকল ছিল। শিয়াওজুনের এই সাজানো জীবনের বিন্দুমাত্র আঁচ পাননি তরুণী। দু’জনের বন্ধুত্ব প্রেমে দানা বাঁধে। সম্পর্কে থাকাকালীন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন শিয়াওজিয়া। বিয়েও করে ফেলেন দু’জনে।
বিয়ের পর শিয়াওজুনের আর্থিক পরিস্থিতির কথা জানতে পারেন শিয়াওজিয়া। সব জানার পরেও বিচ্ছেদের পথে না হেঁটে একা হাতে সন্তান পালনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিছু দিন পর শিয়াওজুনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন তিনি। কিন্তু আইনি বিচ্ছেদ হয়নি তাঁদের।
ঘরছাড়া হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই হং (নাম পরিবর্তিত) নামে এক তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয় শিয়াওজুনের। অনলাইন গেমিংয়ের মাধ্যমে আলাপ হয় দু’জনের। তাঁকেও মিথ্যা কথার জালে ফাঁসিয়ে দেন শিয়াওজুন। হংকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
শিয়াওজুনের সঙ্গে সম্পর্কে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন হং। শিয়াওজুন জানান, ভবিষ্যতে তাঁরা দু’জনে যে বাড়িতে থাকবেন তা মেরামতের প্রয়োজন। সেই অজুহাতে হংয়ের কাছ থেকে সাড়ে ১৬ লক্ষ টাকা ধার নেন শিয়াওজুন।
হং অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে একত্রবাস করতে শুরু করেন শিয়াওজুন। স্ত্রী শিয়াওজিয়া যে আবাসনে থাকতেন, সেখানেই নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন তরুণ।
স্ত্রী এবং প্রেমিকাকে নিয়ে যে আবাসনে শিয়াওজুন থাকতেন, সেই আবাসনের আরও তিন তরুণীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেন তিনি। মিন (নাম পরিবর্তিত) নামে এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করেন শিয়াওজুন। কলেজে পড়তেন মিন। তাঁর কাছ থেকে প্রায় দু’লক্ষ টাকা ধার নেন তিনি।
এর পর শিন (নাম পরিবর্তিত) নামে এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শিয়াওজুন। কলেজপড়ুয়া শিনকেও মিথ্যা কথা বলে টাকা চান তরুণ। অভিযোগ, তরুণীর কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা নেন তিনি।
একই আবাসনের বাসিন্দা ছিলেন শিয়াওলান। পেশায় নার্স ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্কে জড়ান শিয়াওজুন। একই ভাবে শিয়াওলানের কাছ থেকেও লাখখানেক টাকা নেন তরুণ। একই আবাসনে তাঁর স্ত্রী এবং চার প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও কেউ কারও সম্পর্কে জানতে পারেননি। নিপুণ হাতে প্রেমের খেলা খেলতেন শিয়াওজুন।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। টিউশনের টাকা জমা দেওয়ার জন্য রাতারাতি অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে শিনের। শিয়াওজুনকে টাকা ফেরত দিতে বলেন তিনি। প্রেমিকার কথা শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান শিয়াওজুন। শিনকে অসত্যের জালে জড়াতে একটি বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া করেন শিয়াওজুন। সেই গাড়িতে চেপেই শিনের সঙ্গে দেখা করতে যান তরুণ।
গাড়ি থেকে নামার পর শিনের হাতে কালো রঙের একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দেন শিয়াওজুন। শিনকে জানান, সেই ব্যাগে প্রায় ১২ লক্ষ টাকা রয়েছে। কিন্তু এই ব্যাগটি যেন তিনি না খোলেন। ব্যবসার জন্যে এই টাকা প্রয়োজন বলে জানান শিয়াওজুন। প্রেমিকের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন শিন। ব্যাগটি নিয়ে বাড়িও ফিরে যান তিনি। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর নিমেষের মধ্যে বদলে যায় সমস্ত কিছু।
বার বার শিয়াওজুনকে ফোন করতে থাকেন শিন। কিন্তু তাঁর ফোনের কোনও উত্তর দেন না শিয়াওজুন। এক মাস অপেক্ষা করার পর সন্দেহ জাগে শিনের। প্লাস্টিকের ব্যাগটি খুলে দেখেন তিনি। ব্যাগ খুলে দেখেই চমকে যান তিনি। সবই যে নকল নোট!
পুলিশের কাছে শিয়াওজুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন শিন। পুলিশ যখন তদন্ত শুরু করে, তখন একে অপরের কথা জানতে পারেন শিয়াওজিয়া এবং হং। তাঁদের দু’জনের সন্তানের পিতাই যে শিয়াওজুন তা-ও প্রকাশ্যে আসে। তদন্তের পর সাড়ে ন’বছরের সাজা হয় শিয়াওজুনের।
শুধু কারাদণ্ডই নয়, আদালতের তরফে পাঁচ তরুণীকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় শিয়াওজুনকে। জানা যায়, নানা ধরনের বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রায় ৩৩ লক্ষ টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই টাকা বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তার পর তা পাঁচ তরুণীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
সব ছবি: সংগৃহীত।