নতুন খসড়া আইনে বিতর্ক চিনে। কী রয়েছে সেই আইনে? প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, দেশের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত করে এমন পোশাক আর পরা যাবে না। কোন পোশাকের কথা বলেছে সে দেশের সরকার?
এই খসড়া প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে, কড়া শাস্তি। সে ক্ষেত্রে চিনাদের ভাবাবেগে আঘাত করলে জেল বা জরিমানা পর্যন্ত হতে পারে। তবে ঠিক কী পরলে বা করলে নতুন আইন ভাঙা হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে খসড়ায় লেখা নেই।
এই খসড়ার বিষয়ে পরামর্শের জন্য আইনি বিশেষজ্ঞ এবং সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি জনসুরক্ষা আইনেও রদবদলের প্রস্তাব এনেছে চিন সরকার। বহু বছর পর।
তবে পোশাক নিয়ে চিন যে খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে, তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশের বহু মানুষ। সমাজমাধ্যমে সেই নিয়ে মতামত দিয়েছেন তাঁরা।
ঠিক কী লেখা রয়েছে খসড়ায়? তাতে বলা হয়েছে, ‘চিন রাষ্ট্রের ভাবাবেগকে আঘাত করতে পারে বা অবদমিত করতে পারে’ এমন পোশাক বা চিহ্ন পরা যাবে না। এই ধরনের পোশাক পরলে ওই নাগরিকের ১৫ দিন পর্যন্ত জেল বা ৫০০০ ইউয়ান পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫৬ হাজার টাকা জরিমানা।
চিনের ভাবাবেগকে আঘাত করতে পারে, এমন কথা বললে বা প্রতিবেদন লিখলেও একই শাস্তি। সে কথাও লেখা রয়েছে প্রস্তাবে।
‘স্থানীয় হিরো বা শহিদদের নাম’ নিয়ে খারাপ কথা বললে, অবমাননা বা নিন্দা করলেও শাস্তির প্রস্তাব রয়েছে খসড়া আইনে। ওই ‘হিরো বা শহিদ’দের স্মারকমূর্তি ভাঙচুর করলেও চিনে কড়া শাস্তি পেতে হতে পারে। যদি প্রস্তাব আইনে পরিণত হয়।
এ সব নিয়েই ধন্দে চিনের নাগরিকেরা। সমাজমাধ্যমে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, কিসে রাষ্ট্রের ভাবাবেগে আঘাত লাগছে, তা কে ঠিক করবে? কারও আবার প্রশ্ন, পশ্চিমের দেশের পোশাক স্যুট, টাই পরলেও কি শাস্তির মুখে পড়তে হবে?
চিনের জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম ওয়েইবোতে এক ব্যবহারকারীর প্রশ্ন, ‘‘মার্ক্সবাদের জন্ম পশ্চিমের দেশে। তা হলে এ দেশে তার চর্চা বা অস্তিত্বও কি জাতীয় ভাবাবেগে আঘাত করবে?’’
চিনের আইনজীবীদের একাংশ মনে করছেন, এই প্রস্তাবে অনেক বিষয়ই স্পষ্ট নয়। এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে নাগরিকদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে। ইউনিভার্সিটি অফ পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ঝাও হং জানিয়েছেন, এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে বহু মানুষ নিত্য দিন গ্রেফতার হতে পারেন। কোনও পুলিশকর্মী শত্রুতা চরিতার্থ করতেও এই আইনের ব্যবহার করতে পারেন।
এই প্রসঙ্গে গত বছরের একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ঝাও। তিনি জানিয়েছেন, গত বছর সুঝৌতে এক মহিলাকে আটক করা হয়েছিল। তিনি জাপানের সাবেকি পোশাক কিমোনো পরেছিলেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল সেই খবর।
ঝাও জানিয়েছেন, ওই মহিলার বিরুদ্ধে ‘ঝগড়া এবং বচসায় উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এ-ও দাবি করা হয়, জাপানি পোশাক পরেছিলেন বলেই ও সব করছিলেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়। চলতি বছর মার্চে এক চিনা মহিলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জাপানি সেনার উর্দির মতো পোশাক পরেছিলেন তিনি।
গত মাসে রামধনু রঙের পোশাক পরেছিলেন বলে চিনের এক গায়কের অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কয়েক জনকে। সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী, এলজিবিটিকিউদের প্রতীক হল রামধনু পতাকা। সে কারণে ওই পোশাক পরা লোকজনকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় অনুষ্ঠানে।
এই ঘটনার কথা ঝাও প্রকাশ করার পর সরব হয়েছেন বহু সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী। এক জন লিখেছেন, ‘‘কিমোনো পরলে দেশের ভাবাবেগে আঘাত লাগে? এত ঠুনকো চিনের ভাবাবেগ?’’
২০১২ সালে চিনে ক্ষমতায় এসেছেন শি জিনপিং। তার পর থেকেই নাগরিকদের আদর্শ আচরণবিধি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্দেশিকা দিয়েছেন।
চিনের নাগরিকদের কী রকম আচরণ করা উচিত, তা নিয়ে ২০১৯ সালে জিনপিং সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করে। তাতে বলা হয়, নাগরিকদের নম্র আচরণ করতে হবে। জিনপিং এবং তাঁর দলের উপর ‘আস্থা’ রাখতে হবে। পায়ে ধুলো লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো চলবে না।
এ বার নাগরিকদের পোশাক নিয়েও নতুন আইন আনার পথে হাঁটছে জিনপিং সরকার। প্রস্তাব আইনে পরিণত হলে ঠিক কী কী বিধিনিষেধ চাপবে, তা নিয়ে রয়েছে বহু প্রশ্ন।