
‘লেজ কাটা’ অদ্ভুতদর্শন যুদ্ধবিমান উড়িয়ে আটলান্টিক পারের ‘সুপার পাওয়ার’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল ড্রাগন। কিন্তু মাত্র তিন মাসেই বদলাল সেই ছবিটা। বিশ্বের প্রথম ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেট প্রকাশ্যে এনে চিনকে মুখের উপর জবাব দিল আমেরিকা। এর ফলে শক্তির বিচারে আগামী দশকগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে পারবে, তা এককথায় মানছেন তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

চলতি বছরের ২১ মার্চ রাজধানী ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বসে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেটের বিষয়টি ফলাও করে ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই সময়ে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ এবং একগুচ্ছ পদস্থ সেনা অফিসার। অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানটির কোড নাম ‘এফ-৪৭’ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।

ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু জেটটি নিয়ে কথা বলার সময়ে যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘‘সবচেয়ে অত্যাধুনিক, সক্ষম এবং ধ্বংসাত্মক যুদ্ধবিমান হিসাবে এটি তৈরি করা হচ্ছে। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, কোনও শত্রু দেশ এর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।’’ গত পাঁচ বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ‘এফ-৪৭’-এর লাগাতার পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, তাঁর কার্যকালের মেয়াদের মধ্যেই (আগামী চার বছরে) ‘এফ-৪৭’ যুদ্ধবিমানের বহর হাতে পাবে আমেরিকার বায়ুসেনা। তবে প্রথম পর্যায়ে এই লড়াকু জেট কতগুলি তৈরি করা হবে, তা জানা যায়নি। ‘এফ-৪৭’ নির্মাণের ভার বিখ্যাত উড়োজাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা বোয়িংয়ের কাঁধে দিয়েছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘নেক্সট জে়নারেশন এয়ার ডোমিন্যান্স’ (এনজিএডি) প্রকল্পের আওতায় ‘এফ-৪৭’কে তৈরি করবে বোয়িং। সূত্রের খবর, এর জন্য প্রাথমিক ভাবে দু’হাজার কোটি ডলারের বরাত পেয়েছে বিমান নির্মাণকারী সংস্থা। বর্তমানে মার্কিন বায়ুসেনা ‘এফ-২২ র্যাফটার’ নামের দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি লড়াকু জেট ব্যবহার করে। এরই বদলি হিসাবে আসবে ‘এফ-৪৭’।

আমেরিকার বিমানবাহিনীর আশা, ২০৩০ সালের মধ্যে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলি হাতে পাবে তারা। ‘এফ-৪৭’ নির্মাণের বরাত জনপ্রিয় লড়াকু জেট নির্মাণকারী সংস্থা লকহিড মার্টিনের কাছে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোয়িং তা ছিনিয়ে নেওয়ায় ওই কোম্পানির শেয়ারের দর নেমে গিয়েছে।

ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার সময়ে এর একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে আমেরিকা। ‘এফ-৪৭’র বিশেষত্ব অবশ্য নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি একাধিক ড্রোন নিয়ে উড়বে আকাশে। ককপিটে বসে ড্রোনগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন ফাইটার পাইলট। ফলে একাধিক স্তরে আক্রমণ শানাতে পারবে ‘এফ-৪৭’।

মার্কিন সেনা অফিসার মেজর জেনারেল জোসেফ কুঙ্কেল জানিয়েছেন, আগামী দিনে আমেরিকার বায়ুসেনার সমস্ত অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাবে ‘এফ-৪৭’কে। আকাশের লড়াইকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবে এই লড়াকু জেট। এতে যুদ্ধবিমান এবং ড্রোনের মিশেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ। তবে ‘এফ-৪৭’ নির্মাণের খরচ পঞ্চম প্রজন্মের ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’র চেয়ে বেশি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

সূত্রের খবর, ষষ্ঠ প্রজন্মের নতুন লড়াকু জেটটিতে বহুল পরিমাণে কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। আর তাই এর নকশা অন্যান্য যুদ্ধবিমানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা প্রধান জেনারেল ডেভিড অ্যালভিন ইতিমধ্যেই একে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে উল্লেখ করেছেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ আবার ‘এফ-৪৭’র ঘোষণাকে আমেরিকার যুদ্ধবিমানের জন্য ‘ঐতিহাসিক দিন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের কাছে এফ-১৫, এফ-১৬, এফ-২২ আর এফ-৩৫ লড়াকু জেট আছে। তাই বন্ধু আর প্রতিপক্ষদের কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছি। আগামী দিনে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় শক্তি প্রদর্শন করতে আমরা প্রস্তুত।’’

গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান মাওয়ের জন্মদিনে সিচুয়ান প্রদেশের চেংডুতে ‘ঝুহাই এয়ার শো’র আয়োজন করে চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএর বিমানবাহিনী। সেখানে প্রথম বার ‘লেজকাটা’ কিম্ভূতদর্শন একটি যুদ্ধবিমান আকাশে ওড়ায় বেজিং। এটিকে ড্রাগনের ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বলে দাবি করেছিলেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।

লালফৌজের বায়ুবীরদের অস্ত্রাগারে শামিল হতে চলা নতুন ওই হাতিয়ারের পোশাকি নাম ‘জে-৩৬’। দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ষষ্ঠ প্রজন্মের লড়াকু বিমান তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বেজিং। মাঝে ২০১৯ সালে এই প্রকল্পে আরও গতি আনার নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অবশেষে ২০২৪ সালের বিদায়বেলায় ক্ষমতা প্রদর্শন করেন তিনি।

সূত্রের খবর, নতুন প্রজন্মের চিনা যুদ্ধবিমানে রয়েছে তিনটি ইঞ্জিন। ফলে পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু উড়ানগুলির থেকে এর গতিবেগ অনেকটাই বেশি। ‘জে-৩৬’ জেটে রয়েছে টার্বোফ্যান ইঞ্জিন। লেজের মতো অংশ না-থাকায় কোনও ভাবেই একে চিহ্নিত করতে পারবে না রাডার। অর্থাৎ, যুদ্ধবিমানের ‘স্টেল্থ’ শক্তি বাড়িয়েছে বেজিং।

তবে চিনের ‘জে-৩৬’ যুদ্ধবিমান একাধিক ড্রোন নিয়ে আকাশে উড়তে পারে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। সমর বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন এ ব্যাপারে খুব বেশি দূরে নেই ড্রাগন। বায়ুসেনাকে আমেরিকার সমকক্ষ করে তুলতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট শি। এর জন্য বিপুল অর্থও খরচ করছে বেজিং।

‘এফ-৪৭’কে বিশ্বের প্রথম ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বলে ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর প্রধান কারণ হল ‘জে-৩৬’ কোন প্রজন্মের লড়াকু জেট, তা সরকারি ভাবে ঘোষণা করেনি চিন। তবে দু’টি যুদ্ধবিমানেরই প্রযুক্তিগত বহু দিক এখনও অজানা রয়ে গিয়েছে।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তাঁর সম্মানরক্ষার্থে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানটির নাম ‘এফ-৪৭’ রাখা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। দুই ম্যাক (পড়ুন শব্দের দ্বিগুণ) গতিতে ছুটতে পারবে এই লড়াকু জেট। রাডারকে ফাঁকি দিতে এর ‘স্টেল্থ’ ক্যাটেগরি বৃদ্ধি করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, বন্ধু দেশগুলির কাছে ‘এফ-৪৭’ বিক্রি করবে আমেরিকা। মার্কিন বায়ুসেনা এর ব্যবহার শুরু করলে সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কোন কোন দেশ ‘এফ-৪৭’ পাবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

তবে এই ব্যাপারে একটি বিপজ্জনক কথা বলেছেন ট্রাম্প। ‘বন্ধু’ দেশগুলির কাছে ১০ শতাংশ কম শক্তিশালী ‘এফ-৪৭’ বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাফ যুক্তি, আজ যে বন্ধু কাল সে শত্রু হতেই পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর প্রশাসন।
সব ছবি: সংগৃহীত।